শবে বরাত বর্তমান সময়ের বহুল আলোচ্য একটি বিষয়

শবে বরাত বর্তমান সময়ের বহুল আলোচ্য একটি বিষয়। এক দিকে যেমন এ রাতটিকে আতশবাজী, মোববাতী, হালুয়া রুটি ইত্যাদি অশোভনীয় কাজের মাধ্যমে উৎযাপন করা হয় অন্য দিকে একশ্রেনীর মানুষ এটাকে গোড়া শুদ্ধই উপড়ে ফেলতে চান। তারা সাধারনভাবে বলেন, শবে বরাত বলে ইসলামে কিছুই নেই শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতের কোনো ফজীলত সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে বলে তারা মনে করেন না। আমরা এবিষয়ে কিছু তথ্য প্রমাণ পেশ করতে চাই। আশা করি এতে সত্য বিষয়টি উৎঘাটিত হবে। ইনশাআল্লাহ।
লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত এর পরিচয়
লাইলা (ليلة) অর্থ রাত আর বারাআ (براءة) অর্থ মুক্তি। সুতরাং
লাইলাতুল বারাআ অর্থ মুক্তির রজনী। মোট কথা এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত নামে আখ্যায়িত করতে কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না যেহেতু বারাআ অর্থ মুক্তি আর এ রাতে আল্লাহ (সুবঃ) বান্দাদের পাপ থেকে মুক্তি দেন বলে সহীহ সুত্রে প্রমানিত আছে তাছাড়া আলেমরা নামটি ব্যাবহার করেছেন।
এখন শবে বরাত সম্পর্কে কথা হলো। শব (شب) শব্দটি ফার্সী যার অর্থ রাত আর রারাআ (برأت) শব্দটি যদি আরবী শব্দ (براءة) এর বিকৃতরুপ হয় তবে তার অর্থ মুক্তি ফলে শবে বরাত (شبِ برأت) এর অর্থ লাইলাতুল বারাআ এর সমার্থক হবে। তখন এর অর্থ হবে “মুক্তির রজনী” যেমনটি আমরা পূর্বেই বলেছি। অনেকে বারআত শব্দটি আরবী শব্দের বিকৃত রুপ হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি অস্বীকার করেছে
ন তাদের যুক্তি হলো যেহেতু প্রথম শব্দটি ফার্সী তাই পরেটিও ফার্সী হবে এটিই স্বাভাবিক। এটার সম্ভাবনা রয়েছে তবে নিশ্চিত নয়। যেহেতু শবে কদর, শবে মেরাজ, ইত্যাদি শব্দের প্রথম অংশ ফার্সী হলেও পরবর্তী অংশ আরবী। সুতরাং সঠিক কথা হলো বারআত (برأت) শব্দটি আরবী শব্দের বিকৃত রুপও হতে পারে আবার মূল ফার্সী শব্দও হতে পারে। যদি শব্দটি মূল ফার্সী হয় তবে তার অর্থ হবে কোনো কিছু লিপিবদ্ধ করার কাগজ, কার্ড ইত্যাদি। এ রাতে ভাগ্য লেখা হয় এ ধারনা থেকেই সম্ভবত এ নামের উদ্ভব হয়ে থাকবে। ঘটনা যাই হোক এতটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায় যে বর্তমানে উপমহাদেশের অধিবাসীরা “শবে বরাত” বলতে “ভাগ্যরজনী” বুঝে থাকেন। সঠিক মতে ভাগ্যরজনী হলো লাইলাতুল কদর লাইলাতুল বারাআ নয়। শাবান মাসের মাঝরাতে ভাগ্য লেখা হয় বলে যা কিছু বর্ণিত আছে তা প্রমানিত নয়।
শাবান মাসের ফজীলত সম্পর্কে হাদীস
إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِن
নিশ্চয় আল্লাহ শাবান মাসের মাঝ রাতে বান্দাদের দিকে দৃষ্টি দেন এবং সমস্ত সৃষ্টিকে ক্ষমা করেন শুধু মুশরিক ও অন্য মুসলিমের সাথে বিবাদে লিপ্ত ব্যক্তি ছাড়া।
{ইবনে মাযা/ كتاب إقامة الصلاة والسنة فيها/ باب ما جاء في ليلة النصف من شعبان}
{মিশকাত/ كتاب الصلاة/ باب قيام شهر رمضان - الفصل الثالث}
হাদীসটির অন্য একটি রেওয়ায়েত হলো,
يطلع الله إلى جميع خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن
এই হাদীসটির অর্থ পূর্বের হাদীসটির মতই শুধু শব্দগত কিছু পার্থক্য ছাড়া।
{তিবরানী, ইবনে হিব্বান, আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, সিলসিলাতুস-সাহীহা/১১৪৪}
শায়খ আলবানী সিলসিলাতুস সাহীহাতে বলেন,
حديث صحيح، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا وهم معاذ ابن جبل وأبو ثعلبة الخشني وعبد الله بن عمرو وأبي موسى الأشعري وأبي هريرة وأبي بكر الصديق وعوف ابن مالك وعائشة
এই হাদীসটি সহীহ। এটি বহু সংখক সাহাবী হতে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত আছে যার একটি অন্যটিকে শক্ত করে। যেসব সাহাবা হতে হাদীসটি বর্ণিত আছে তারা হলেন, মুআজ ইবনে জাবাল, আবু ছা’লাবা, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আবু মুসা আল আশআরী, আবু হুরাইরা, আবু বকর আস-সিদ্দীক, আওফ ইবনে মালিক এবং আয়েশা (রা)। {সিলসিলাতু আস সহীহা/১১৪৪}
ইবনে তাইমিয়া বলেন,
فأما صوم يوم النصف مفردا فلا أصل له بل إفراده مكروه وكذلك اتخاذه موسما تصنع فيه الأطعمة وتظهر فيه الزينة هو من المواسم المحدثة المبتدعة التي لا أصل لها
নির্দিষ্টভাবে শাবান মাসের মাঝ রাতের পরদিন সওম পালন করার কোনো ভিত্তি নেই বরং একাজ অপছন্দনীয়। একইভাবে এই দিবসকে উৎসবের দিন মনে করে খাবর তৈরী করা বা সাজ সজ্জা করা ভিত্তিহীন বিদআতী উৎসব সমূহের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।{ইক্তিদাউস-সিরাতিল মুস্তাকীম}
বাহরুর রায়েকে বলা হয়েছে,
وَإِسْرَاجُ السُّرُجِ الْكَثِيرَةِ فِي السِّكَكِ وَالْأَسْوَاقِ لَيْلَةَ الْبَرَاءَةِ بِدْعَةٌ وَكَذَا فِي الْمَسَاجِدِ
লাইলাতুল বারায়ার রাস্তা ও বাজার বা মসজিদ সমুহ বাতি দ্বারা শোভিত করা বিদআত ।
ইমাম আন-নাব্বী,
من البدع المنكرة ما يفعل في كثير من البلدان من ايقاد القناديل الكثيرة العظيمة السرف في ليال معروفة من السنة كليلة نصف شعبان فيحصل بسبب ذلك مفاسد كثيرة منها مضاهات المجوس في الاعتناء بالنار والاكثار منها ومنها اضاعة المال في غير وجهه ومنها ما يترب على ذلك في كثير من المساجد من اجتماع لصبيان وأهل البطالة ولعبهم ورفع أصواتهم وامتهانهم المساجد وانتهاك حرمتها وحصول أوساخ فيها وغير ذلك من المفاسد التى يجب صيانة المسجد من أفرادها
বছরের কিছু বিশেষ রাতে যেমন শাবান মাসের মাঝ রাতে বিভিন্ন এলাকাতে বড় বড় ব্যায়বহুল বাতি প্রজ্বলিত করা হয় এটা নিকৃষ্ট বিদআত সমূহের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। কেননা এর মধ্যে বহু অপ্রিতীকর বিষয় রয়েছে। যথা মাজুসীদের মতো আগুনকে অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়া, অকারণে সম্পদ ব্যায় করা। তাছাড়া এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ছোট ছেলে মেয়ে ও কুপ্রকিতির লোকেরা মসজিদে একত্রিত হয় এবং খেল তামাশা করে ও হৈ চৈ করে। এভাবে তারা মসজিদের সম্মান বিনষ্ট করে, মসজিদ নোংরা হয় ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষতিকর কাজ একত্রে ঘটে যার কোনো একটি হতেও মসজিদকে পবিত্র রাখা উচিত ছিল। {আল-মাজমু’}

কোনো কোনো এলাকাতে হালুয়া রুটির প্রচলন আছে। এটাও ইবনে তাইমিয়ার কথার মধ্যে পড়ে। কেউ কেউ বলেন এ মাসে রসুলুল্লাহ (সাঃ) উহুদের যুদ্ধে আহত হন এবং তার দাত ভেঙে যায় ফলে তিনি অন্যান্য খাবারের পরিবর্তে হালুয়া রুটি খেতেন তাই এ দিনে হালুয়া রুটি খাওয়া সুন্নাত। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই বরং উহুদের যুদ্ধ হয়েছিল শবে বারাতের প্রায় দুই মাস পর শাওয়াল মাসের ৭ তারিখ মতান্তরে ১১ তরিখ। ইবনে ইসহাক বলেন,

وَغَزَتْهُ قُرَيْشٌ غَزْوَةَ أُحُدٍ فِي شَوّالٍ سَنَةَ ثَلَاثٍ
কাফিররা রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে উহুদে যুদ্ধ করতে আসে তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে।{ইবনে হিশাম, আর রাহীকুল মুখতুম}

Comments