ওহীর প্রকারভেদ

ওহীর প্রকারভেদ: কুরআন ও হাদীস
  পিডিএফ ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন
পূর্ববর্তী প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করেছি যে, ইসলামী আকীদার উৎস ও ভিত্তি ওহীর ইলম। আজ আমার ওহীর প্রকারভেদ আলোচনা করব। রাসূলুল্লাহ  -এর প্রতি দু প্রকারের ওহী প্রেরিত হয়েছে এবং দু ভাবে তা সংরক্ষিত হয়েছে: কিতাব ও হিকমাহ বা সুন্নাত। এখানে আমরা এই দু প্রকারের ওহীর বিষয়ে আলোচনা করব।
কুরআন মাজীদ:
কুরআন কারীম মানব জাতির কাছে প্রেরিত মহান আল্লাহর সর্বশেষ বাণী।

এর প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ও বাক্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। মহানবী মুহাম্মদ ()-এর বযস যখন ৪০ বৎসর তখন থেকে আল্লাহ তাঁর কাছে ওহীর
মাধ্যমে কুরআন প্রেরণ করতে শুরু করেন। পরবর্তী ২৩ বৎসর যাবৎ বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন মত কুরআনের বিভিন্ন
সুরা ও আয়াত অবতীর্ণ করা হয়। ২৩ বৎসরে তা পরিপূর্ণরূপে অবতারিত হয়। আল্লাহর নিকট থেকে প্রধান ফিরিশতা (অৎপযধহমবষ) জিবরাঈল (আ) রাসূলুল্লাহ  -এর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। রাসূলুল্লাহ () তা পরিপূর্ণভাবে মুখস্থ করে নিতেন। এরপর তিনি তার সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিতেন তা মুখস্থ করার জন্য এবং লিখে রাখার জন্য। এভাবে পরিপূর্ণ কুরআন রাসূলুল্লাহ  -এর জীবদ্দশায় পৃথক পৃথক কাগজ, চামড়া, হাড় ইত্যাদিতে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং অসংখ্য সাহাবী তা মুখস্থ করে নেন। তাঁর সময় থেকেই তিনি ও সাহাবীগণ সাধারণ সালাতে এবং বিশেষত রাত্রিতে তাহাজ্জুদের সালাতে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও খতম করতেন, অর্থাৎ পরিপূর্ণ কুরআন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ পাঠ করতেন। অনেক সাহাবীই ৩ থেকে ৭ রাত্রিতে তাহাজ্জুদের সালাতে কুরআন খতম করতেন। কেউ কেউ একটু বেশি সময় ধরে কমবেশি এক মাসের মধ্যে তাহাজ্জুদ সালাতে কুরআন খতম করতেন। এছাড়া নিজের কাছে সংরক্ষিত লিখিত পাণ্ডুলিপি থেকে দেখে দেখে দিবসে ও রাত্রিতে তা পাঠ করা ছিল সাহাবীগণের প্রিয়তম ইবাদত ও হৃদয়ের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি ও আনন্দের কর্ম।
এভাবে মূলত মুমিনদের হৃদয়ে মুখস্থ রেখে ও নিয়মিত রাতের সালাতে (তাহাজ্জুদে) খতমের মাধ্যমেই কুরআনকে অবিকল আক্ষরিকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন আল্লাহ। এছাড়া রাসূলুল্লাহ  -এর ওফাতের পরের বৎসর খলীফা আবূ বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ  -এর সময়ে লিখিত পৃথক কাগজ, চামড়া, হাড় ইত্যাদি থেকে একত্রিত করে পুস্তকাকারে সংকলন করান। পরবর্তীকালে খলীফা উসমান (রা) তাঁর শাসনামলে নতুন মুসলিম প্রজন্মের মানুষদের বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষা ও মুখস্থ করণের সুবিধার্থে আবূ বাক্র (রা) কর্তৃক পুস্তকাকারে সংকলিত কুরআনটির বিভিন্ন অনুলিপি তৈরি করে বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেন।
এভাবে সকল মুসলিমের প্রাত্যহিক পাঠের প্রিয়তম ধর্মগ্রন্থ হিসেবে কুরআন কারীম পরিপূর্ণ ও অবিকৃতভাবে অগণিত মানুষের হৃদয়পটে এবং পুস্তকাকারে সংরক্ষিত হয়। যেভাবে তা রাসূলুল্লাহ  -এর উপর অবতারিত হয়েছে আজ পর্যন্ত ঠিক তেমনিভাবে অবিকৃত ও অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত রয়েছে এবং সকল যুগেই লক্ষ লক্ষ মুসলিম তা পরিপূর্ণ মুখস্থ করে রেখেছেন।
এ কুরআনই মানব জাতির পথের দিশারী এবং সকল কল্যাণের উৎস। এতে রয়েছে সকল উপদেশ, শিক্ষা ও সকল আত্মিক ও মানসিক অসুস্থতার মহৌষধ। কুরআনের বৈশিষ্ট্য কুরআন কেন্দ্রিক ঈমান, আকীদা ও জীবন গঠন সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে ‘আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান’ ও ‘কুরআনের প্রতি ঈমান’ পরিচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করব। কুরআনই প্রত্যেক মুমিনের বিশ্বাস, ঈমান বা আকীদার মূল ভিত্তি। কুরআন কারীমে যা কিছু বলা হয়েছে তা আক্ষরিকভাবে ও সরলভাবে বিশ্বাস করাই ইসলামী আকীদার মূল ভিত্তি। কোন্ বিষয়ে বিশ্বাস করতে হবে, কিভাবে বিশ্বাস করতে হবে, কিসে বিশ্বাস নষ্ট হবে, কিসে কুফরী হবে, কিসে শিরক হবে, কিভাবে ও কি কারণে পূর্ববর্তী উম্মাতগণ ঈমান লাভ করার পরেও বিভ্রান্ত হয়েছিল, কিভাবে বিভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষা করা যায়, কিভাবে ঈমানদার ব্যক্তি জীবনযাপন করবেন, ইত্যাদি বিষয়ই হলো, কুরআন কারীমের মূল শিক্ষা। আল-কুরআনই ইসলামী আকীদার প্রধান ও মূল উৎস।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআনের আয়াত থেকে আক্ষরিক, সরল ও স্বাভাবিক যে অর্থ বুঝা যায় তাই আকীদার মূল উৎস, কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা নামে পরিচিতি পরবর্তী যুগগুলির আলিমগণের মতামত আকীদার উৎস নয়। মহান আল্লাহ কুরআন কারীমকে সহজ ও অত্যন্ত সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল করেছেন এবং তা বুঝা সহজ করেছেন বলে কুরআন কারীমে বারংবার উল্লেখ করেছেন। সাধারণভাবে কুরআন কারীম নিজেই নিজের ব্যাখ্যা করে। এছাড়া কুরআনের ব্যাখ্যার বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হলে তাও ওহীর ব্যাখ্যা বলে গণ্য। এছাড়া কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সাহাবী-তাবিয়ীগণের ব্যাখ্যাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদাণ করা হয়। পরবর্তী যুগের আলিমগণ তাফসীরের ক্ষেত্রে যা কিছু বলেছেন তা আলিমগণের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ, রায় বা মতামত হিসেবে পর্যালোচনার গুরুত্ব লাভ করে, কিন্তু কখনোই তা ওহীর সমতুল্য বা সম্পূরক নয় এবং তা আকীদার ভিত্তি নয়। ।
হাদীস বা সুন্নাতে রাসূল ():
পরিচয় ও সংজ্ঞা
আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ  -এর নিকট যে ওহী পাঠাতেন তা ছিল দু প্রকারের। প্রথম প্রকার ওহী কুরআন, যা তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো শব্দ ও অর্থসহ আক্ষরিকভাবে মুখস্থ করতেন, সাহাবীদেরকে মুখস্থ করাতেন এবং লিখাতেন। দ্বিতীয় প্রকার ওহীর মূল অর্থ, ‘জ্ঞান’ বা ‘প্রজ্ঞা’ আল্লাহ তাঁর উপর নাযিল করতেন। তিনি নিজের ভাষায় তা সাহাবীদেরকে বলতেন, শিক্ষা দিতেন, মুখস্থ করাতেন এবং কখনো কখনো লিখাতেন। কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে প্রথম প্রকার ওহীকে ‘কিতাব’ বা গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় প্রকার ওহীকে ‘হিকমাহ’ বা প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করা হয়েছে। একস্থানে মহান আল্লাহ বলেন:
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُبِينٍ
“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্য অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁর আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ তাদেরকে শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যেই ছিল।”
( সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৬৪ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা বাকারা: ১২৯, ১৫১, ২৩১ আয়াত; সূরা নিসা: ১১৩ আয়াত; সূরা আহযাব ৩৪ আয়াত; সূরা জুমুআহ ২ আয়াত)
এই দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ‘হাদীস’ বা ‘সুন্নাত’ নামে পৃথক ভাবে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।
হাদীস: হাদীস শব্দের আভিধানিক অর্থ সংবাদ, কথা বা নতুন বিষয়।
(ইবনু মানযূর; লিসানুল আরব ২/১৩১-১৩৪; যাইনুদ্দীন রাযী, মুখতারুস সিহাহ ১/৫৩।)
ইসলামী পরিভাষায় হাদীস বলতে সাধারণত রাসূলুল্লাহ ()-এর কথা, কর্ম বা অনুমোদনকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোকে রাসূলুল্লাহ () যা বলেছেন, করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তাকে হাদীস বলা হয়। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় “যে কথা, কর্ম, অনুমোদন বা বিবরণকে রাসূলুল্লাহ -এর বলে প্রচার করা হয়েছে বা দাবী করা হয়েছে” তাই “হাদীস” বলে পরিচিত। এছাড়া সাহাবীগণ ও তাবেয়ীগণের কথা, কর্ম ও অনুমোদনকেও হাদীস বলা হয়। রাসূলুল্লাহ -এর কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে “মারফূ’ হাদীস” বলা হয। সাহাবীগণের কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে “মাউকূফ হাদীস” বলা হয়। আর তাবেয়ীগণের কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসে “মাকতূ’ হাদীস” বলা হয়।
(ইরাকী, যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন (৮০৬হি), আত-তাকয়ীদ ওয়াল ঈদাহ, পৃ: ৬৬-৭০; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৫২-৬৩; সাখাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান (৯০২হি), ফাতহুল মুগীস ১/৮-৯, ১১৭-১৫৫; সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আব্দুর রাহমান ইবনু আবী বকর (৯১১হি), তাদরীবুর রাবী ১/১৮৩-১৯৪)
এখানে লক্ষণীয় যে, যে কথা, কাজ, অনুমোদন বা বর্ণনা রাসূলুল্লাহ ()-এর বলে দাবী করা হয়েছে বা বলা হয়েছে তাকেই মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘হাদীস’ বলে গণ্য করা হয়। তা সত্যই রাসূলুল্লাহর () কথা কিনা তা যাচাই করে নির্ভরতার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের বিভিন্ন প্রকারে ও পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।
সাধারণভাবে সুন্নাত ও হাদীস অনেকটা সমার্থক।
(বিস্তারিত দেখুন, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৩-১১০।)
বস্তুত কুরআন কারীমের ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রয়োগই হাদীস বা সুন্নাত। কুরআনের পাশাপাশি অতিরিক্ত যে ওহীর জ্ঞান বা প্রজ্ঞা আল্লাহ রাসূলুল্লাহ  -কে প্রদান করেছিলেন, তার ভিত্তিতে তিনি কুরআনের বিভিন্ন বক্তব্য ব্যাখ্যা করেছেন এবং বাস্তব জীবনের সকল ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করেছেন। কুরআন ও হাদীসই আমাদের সকল জ্ঞানের ও কর্মের মূল উৎস। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন : রাসূলুল্লাহ  বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেন :
إِنِّيْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنْ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوا أَبَداً، كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ.
“আমি তোমাদের মধ্যে যা রেখে যাচ্ছি তা যদি তোমরা আঁকড়ে ধরে থাক তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, তা হলো Ñ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত।”
(হাকিম, আল-মুস্তাদরাক ১/১৭১, নং ৩১৮/৩১। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। আরো দেখুন: আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৯৩।)
এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলিম জীবনের সকল বিশ্বাস এবং সকল কর্মের ভিত্তি আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ  -এর সুন্নাত বা হাদীস। আমাদের ঈমান-আকীদা বা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত যে কোনো বিষয় সঠিক কিনা তা জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে বিষয়টি কুরআন বা হাদীসে আছে কিনা এবং কিভাবে আছে।
সহীহ হাদীস বনাম যয়ীফ হাদীস
আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা লেখাতেন এবং মুখস্থ করাতেন। তিনি কুরআন কারীমের ব্যাখ্যা হিসাবে যা বলতেন বা শেখাতেন সে সকল শিক্ষা অর্থাৎ হাদীস তিনি সাধারণত লিখতে নিষেধ করতেন। কারণ তাঁর জীবদ্দশায় কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছিল, যা মুসলিমগণ মুখস্থ করতেন এবং বিক্ষিপ্ত চামড়ার টুকরো, মাটির পাত, পাথর, খেজুর গাছের বাকল ইত্যাদিতে লিখে নিতেন। এ অবস্থায় হাদীস লেখা হলে ভুলবশত একজন মুসলিম কোনো হাদীসকে কুরআনের লিখিত পৃষ্ঠার সাথে মিশিয়ে ফেলতে পারেন এবং এভাবে রাসূলুল্লাহ -এর ইন্তেকালের পরে কুরআন নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। কুরআনের পরিপূর্ণ বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য তিনি মুসলিমদেরকে কুরআন মুখস্থ করতে ও লিখতে বলতেন। আর তাঁর বাণী ও কর্ম ,অর্থাৎ হাদীস শুধমাত্র মুখস্থকরে বর্ণনা করতে ও মানুষদেরকে শেখাতে বলতেন। এক্ষেত্রে তিনি হাদীস মুখস্থ করা ও বর্ণনার ক্ষেত্রে পরির্পর্ণ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন কেউ তাঁর নামে মিথ্যা না বলে, বা এমন কথা তাঁর নামে না বলে যা তিনি বলেন নি। আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ  বলেছেন:
لا تَكْتُبُوا عَنِّي وَمَنْ كَتَبَ عَنِّي غَيْرَ الْقُرْآنِ فَلْيَمْحُهُ وَحَدِّثُوا عَنِّي وَلا حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ [متعمدا] فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ”
‘‘তোমরা আমার কাছ থেকে কিছু লিখবে না। যদি কেউ কুরআন ছাড়া আর কিছু লিখে থাক তাহলে তা মুছে ফেলবে। তোমরা আমার হাদীস মৌখিকভাবে বর্ণনা কর, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। যে ব্যক্তি আমার ব্যাপারে (ইচ্ছা করে) মিথ্যা কথা বলবে, সে ব্যক্তি অবশ্যই জাহান্নামের বাসিন্দ হবে।’’ (মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৯৮)
মাদানী জীবনের শেষ দিকে তিনি কোনো কোনো সাহাবীকে হাদীস লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দেন। বিশেষত বিদায় হজ্জের সময় তিনি হাদীস লেখার অনুমতি দেন। তবে রাসূলুল্লাহ ()-এর যুগে সাধারণভাবে হাদীস লিপিবদ্ধ করা হয় নি। কোনো কোনো সাহাবী কিছু হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। অধিকাংশ সাহাবী তাঁর শিক্ষা, বাণী, কর্ম অত্যন্ত যতেœর সাথে মুখস্থ করতেন, পরস্পরে তা আলোচনা করতেন এবং সেভাবে জীবন পরিচালনা করতেন।
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ  তাঁর হাদীস হুবহু মুখস্থ করে তা প্রচার করতে নির্দেশ দিযেছেন।
(তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৩৩-৩৪; আবু দাউদ, আস-সুনান ৩/৩২২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৮৪-৮৬; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১/২৬৮, ২৭১, ৪৫৫; হাকিম নাইসাপূরী, আল-মুসতাদরাক ১/১৬২, ১৬৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৩৮-১৩৯।)
অপরদিকে কোনো মানবীয় কথা যেন তাঁর নামে প্রচারিত হতে না পারে সেজন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নামে মিথ্যা বা অতিরিক্ত কথা বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তিনি বারংবার সতর্ক করেছেন। উপরের হাদীসে আমরা তা দেখেছি। ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’-সহ প্রায় ১০০ জন সাহাবী এই মর্মে রাসূলুল্লাহ -এর সাবধান বাণী বর্ণনা করেছেন। আর কোনো হাদীস এত বেশি সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়নি।
(নববী, ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ (৬৭৬হি), শারহু সাহীহ মুসলিম ১/৬৮, ইবনুল জাউযী, আল-মাউযূ‘আত ২৮-৫৬।)
উম্মাতের মধ্যে জালিয়াত ও জাল হাদীসের প্রাদুর্ভাব ঘটবে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।( মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২।)
যাচাই না করে কোনো হাদীস গ্রহণ করতে রাসূলুল্লাহ  নিষেধ করেছেন। যদি কেউ যাচাই না করে যা শুনে তাই হাদীস বলে গ্রহণ করে ও বর্ণনা করে তাহলে হাদীস যাচাইয়ে তার অবহেলার জন্য সে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হবে।
(মুসলিম, আস-সহীহ ১/১০।)
এ সকল নির্দেশনার ভিত্তিতে সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তাঁরা সাধারণত হাদীস বলতেন না। কখনো হাদীস বললে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বলতেন। অন্যের বলা হাদীস যাচাই বাছাই না করে গ্রহণ করতেন না। বর্ণনার নির্ভুলতা বা বিশুদ্ধতায় সন্দেহ হলে বর্ণনাকারীকে প্রশ্ন করে, অন্যান্য ব্যক্তিদেরকে প্রশ্ন করে বা বর্ণনাকারীকে শপথ করিয়ে বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। এরপরও সন্দেহ থাকলে তারা হাদীস গ্রহণ না করে প্রত্যাখ্যান করতেন। সাহাবী ছাড়া অন্য কেউ হাদীস বললে সনদ ছাড়া হাদীস গ্রহণ করতেন না। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার লেখা ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থে।
সাহাবীগণের কর্মপদ্ধিতর অনুসরণে তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের আলিমগণ হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করেছেন। যাচাই-বাছাইয়ে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হাদীসকে তারা ‘সহীহ’ বা ‘হাসান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর অশুদ্ধ হাদীসকে যয়ীফ হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন। যয়ীফ হাদীসের মধ্যে রয়েছে বানোয়াট বা জাল হাদীস।
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়: (১) ‘আদালত’: হাদীসের সকল রাবী (বর্ণনাকারী) পরিপূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত, (২) ‘যাবত’: তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে সকল রাবীর ‘নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা’ পূর্ণরূপে বিদ্যমান বলে প্রমাণিত, (৩)‘ইত্তিসাল’: সনদের প্রত্যেক রাবী তাঁর ঊর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন বলে প্রমাণিত, (৪) ‘শুযূয মুক্তি’: হাদীসটি অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত এবং (৫) ‘ইল্লাত মুক্তি’: হাদীসটির মধ্যে সুক্ষ্ম কোনো সনদগত বা অর্থগত ত্র“টি নেই বলে প্রমাণিত। প্রথম তিনটি শর্ত সনদ কেন্দ্রিক ও শেষের দুইটি শর্ত মূলত অর্থ কেন্দ্রিক। দ্বিতীয় শর্তে সামান্য দুর্বলতা থাকলে হাদীসটি ‘হাসান’ বলে গণ্য হতে পারে।
(বিস্তারিত দেখুন: ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ২৩-২৫; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৭-৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/২৫-৩১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৬৩-৭৪; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৪-৩৬, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃ. ৫৬-১২৩।)
এ সকল শর্তের অবর্তমানে হ্দাীসটি যয়ীফ বা দুর্বল অথবা বানোয়াট বা মাউযূ হাদীস বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার জন্য ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য।
আকীদার ক্ষেত্রে অবশ্যই কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের উপরেই নির্ভর করতে হবে। সকল যুগে সকল ইমাম ও আলিম এ বিষয়ে সতর্ক থেকেছেন। তাঁরা সর্বদা সহীহ্ বা বিশুদ্ধ হাদীসের উপর নির্ভর করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) বলেছেন:
إذا جاء الحديث الصحيح الإسناد عن النبي  أخذنا به ولم نَعْدُهُ
‘‘রাসূলুল্লাহ () থেকে সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া গেলে তাঁর উপরেই আমরা নির্ভর করব, তার বাইরে যাব না।’’
(ইবনু আব্দিল বার, আল ইনতিকা ফী ফাযাইলিল সালালাতিল আইম্মা, পৃ ১৪৪।)
ইমাম আবু হানীফা (রাহ) তাঁর রচিত ‘আল ফিকহুল আকবার’ নামক গ্রন্থে বলেছেন:
وسائر علامات يوم القيامة على ما وردت به الأخبار الصحيحة حق كائن
“কিয়ামতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই।”
(মোল্লা আলী কারী, শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৯০-১৯২ ও ৩২৭।)
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসূফ (রাহ) ও ইমাম মুহাম্মাদের (রাহ) মাযহাবের ভিত্তিতে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম আবূ জাফার তাহাবী (৩২১ হি) বলেন:
وجميع ما صح عن رسول الله  من الشرع والبيان حق. … وكل ما جاء في ذلك من الحديث الصحيح عن رسول الله  فهو كما قال …
“শরীয়ত এবং বিবরণ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ  থেকে যাক কিছু সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে সবই হক্ক। ….. এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ  থেকে সহীহ হাদীসে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই তিনি যেরূপ বলেছেন সেরূপই বিশ্বাস করতে হবে।”
(আবূ জাফার তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০, ১৪।)


ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট