মি’রাজের শিক্ষা

মি’রাজের শিক্ষা
মি’রাজ রসূল সা.-এর জীবনে এক বিস্ময়কর ঘটনা। এক রাতে মসজিদুল হারাম থেকে দূরবর্তি মসজিদ মসজিদুল আকসা গমন এবং সেখান থেকে ঊর্ধালোকে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন, বেহেশ্ত-দোযখ অবলোকনসহ আবার রাতেই ফিরে আসা-যা অতীতে কখনো কারো দ্বারা ঘটেনি বা কেউ দাবীও করেনি; সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু অসম্ভব নয়। অসম্ভব নয় এই কারণে যে, কাজটি ঘটিয়েছেন স্বয়ং
আল্লাহ তায়ালা, যাঁর কাছে সম্ভব-অসম্ভব প্রশ্ন একবারেই অবান্তর। তিনি বলেন- ‘পবিত্র ও মহিমান্বিত (সেই আল্লাহ তায়ালা), যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপার্শ্বিকতাকে তিনি আগেই বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম, যেন তিনি তাকে তাঁর কিছু নিদর্শন দেখাতে পারেন, মূলত তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বস্রষ্টা’। কুরআন মজিদে এতটুকুই বলা হয়েছে এবং হাদিসে অতিরিক্ত যা আছে তা কুরআনেরই পরিপূরক। অন্তত ২৫ জন সাহাবী মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মি’রাজ স্বপ্নযোগে নয় বরং সশরীরেই সংঘটিত হয়েছে বলে রসূল সা. মি’রাজ থেকে ফিরে এসে ঘোষণা করলে আরবের কাফির-মুশরিকরা রসূল সা.-এর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। এ ঘটনায় অনেক দুর্বল ঈমানদারের ঈমান নড়বড়ে হয়ে যায়। কাফিররা রসূল সা.-এর নবুয়্যত দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করার একটা মোক্ষম সুযোগ হিসেবে এটাকে গ্রহণ করে এবং তারা আবু বকর রা.সহ নেতৃস্থানীয়দের ডেকে এনে রসূল সা.-কে গতরাতের ঘটনা বিবৃত করার জন্য আহবান জানায়। কোন দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই তিনি সবিস্তারে ঘটনা বর্ণনা করেন। কারণ নবী-রসূলগণ সত্য প্রকাশে কখনও কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করেন না। আবু বকর রা. রসূল সা.-এর মুখ থেকে ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিক বলে উঠেন ঘটনা সত্য এবং আমি তা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আল্লাহর নবী সা. তাঁকে সিদ্দিক উপাধীতে ভূষিত করেন। রসূল সা. ইতোপূর্বে কখনই বায়তুল মাকদাসে যাননি। কিন্তু আবু বকর রা.সহ সেখানে উপস্থিত অনেক মুরুব্বীস্থানীয় ব্যক্তি বায়তুল মাকদিসে গিয়েছিলেন। কাফিরদের মুখ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে আবু বকর রা. মসজিদে আকসার একটি বর্ণনা দানের জন্য রসূল সা.-কে বলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর সামনে মসজিদে আকসাকে তুলে ধরলে তিনি সবিস্তারে মসজিদের বর্ণনা প্রদান করেন এবং সেখানে উপস্থিত লোকজনদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। তাতে সবাই নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া আল্লাহ তায়ালার ছুবহানাল্লাহ ও আব্দ শব্দচয়নেও বোঝা যায়, এটা সশরীরে ঘটে যাওয়া একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা।
আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অসংখ্য নবী-রসূলের মধ্যে সর্বশেষ নবী ও রসূল হলেন আমাদের প্রিয়তম নবী, সাইয়্যেদুল মুরসালিন মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সা.। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব (তিনি তাঁর আপন রসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীনের ওপর একে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, যদিও শিরকবাদীগণ মোটেই বরদাশত করবে না) দিয়েই এ জমিনে প্রেরণ করেন। তাই যখনই তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন- ‘হে দুনিয়ার মানুষ! তোমরা বলো- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে’। এ ঘোষণার সাথে সাথে তাঁর আপন চাচা আবু লাহাবসহ আরবের মুশরিকরা প্রচন্ডভাবে বিরোধীতা শুরু করে দেয়। অথচ এই আবু লাহাবই তার এতিম ভাতিজার জন্মের খবরে এত খুশি হয়েছিল যে, উট যবেহ করে লোকদেরকে খাইয়েছিল এবং যে দাসী এ শুভ সংবাদ তাকে দিয়েছিল তাকে সে মুক্ত করে দিয়েছিল। নবী ছিলেন তাঁর বংশ ও জাতির নয়নের মনি, সকলের প্রিয়ভাজন ও আল-আমিন। তাদের বিবাদ-বিসংবাদের মিমাংসাকারী, তাদের ধন-সম্পদের আমানতদার এবং সকল সৎ চারিত্রিকগুণের সমাহার ছিল তাঁর মাঝে। অথচ দ্বীনের দাওয়াত দানের সাথে সাথে রাতারাতি তিনি জাতির ভয়ঙ্কর দুশমনে পরিণত হন। তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সয়লাব বয়ে যায়। তিনি যা নন; তাঁকেই তাই বলা হতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শান্তনা দেন- ‘হে নবী! আমি জানি ওরা যে সব কথাবার্তা বলে তাতে তোমার বড়ই মনোকষ্ট হয়, কিন্তু জালেমরা তোমাকে নয়; আল্লাহর নিদর্শনকেই তারা অস্বীকার’। এ অপপ্রচার শুধু সে সময়েই সীমাবদ্ধ নয়, আজও যারা নবীর উত্তরাধিকার হিসেবে দাওয়াতী দ্বীনের কাজ করে যাচ্ছে- সে সব বরেণ্য আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও ঈমানদারদের বিরুদ্ধে সীমাহীন অপপ্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছে। অত্যাচার-নির্যাতনে আল্লাহর রসূল সা. ও তাঁর সাথীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লে এক সময় সাহাবায়ে কেরামদের একটি অংশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হন। এত জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেও আল্লাহর রসূল সা. ও তাঁর সাথীদের দাওয়াতী দ্বীনের কাজ অব্যাহত থাকে। জুলুম-নির্যাতনে পরম ধৈর্য অবলম্বনের তাগিদ আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। হামলার পরিবর্তে কোন হামলা নয় বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেও কোন গোপনে প্রতিশোধও নয়। কেবল নীরবে সয়ে যাওয়া ও আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করাই ছিল মু'মিনদের দায়িত্ব। সে সময়ে আরবের প্রত্যেক গোত্র থেকে কিছু সৎ-স্বভাবসম্পন্ন মানুষ আল্লাহর দ্বীন কবুল করে রসূলের জামাতে শরীক হন। এরই মধ্যে মদীনার আওজ ও খাজরাজ গোত্রের বেশ প্রভাবশালী কিছু লোক ইসলাম কবুল করে রসূল সা.-কে মদীনায় আমন্ত্রণ জানান এবং সবধরনের সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। হিজরতের এক বছর পূর্বে নিপীড়ন-নির্যাতনের চরম মুহূর্তে রসূল সা.-এর জীবনে বিস্ময়কর ঘটনা মি’রাজ সংঘটিত হয়। যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে এ দুনিয়াতে প্রেরণ করে তা পূর্ণতা লাভের সময় ঘনিয়ে আসার পূর্ব দিয়ে আল্লাহ তাঁর নবীকে সৃষ্টির অনেক নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করান এবং তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে ৫ ওয়াক্ত সালাতসহ একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৪টি মূলনীতি প্রদান করেন যা মি’রাজ থেকে ফিরে এসে জনসমক্ষে তিনি (সূরা বনি-ইসরাইল) পেশ করেন। এর এক বছর পরেই তাঁকে হিজরতের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয় এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে রাষ্ট্রশক্তি চাওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়। কুরআনের বাণী- আর দোয়া করোঃ ‘হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো সত্যতার সাথে বের করো এবং তোমার পক্ষ থেকে একটি কর্তৃত্বশীল পরাক্রান্ত শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও’৷ অর্থাৎ তুমি নিজেই আমাকে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দান করো অথবা কোন রাষ্ট্র ক্ষমতাকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও, যাতে তার ক্ষমতা ব্যবহার করে আমি দুনিয়ার বিকৃত ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারি, অশ্লীলতা ও পাপের সয়লাব রুখে দিতে পারি এবং তোমার ন্যায় বিধান জারি করতে সক্ষম হই। আল্লাহপাকের সাহায্যে রসূল সা. যে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন তার মৌলনীতি (রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনীতিক ও পারিবারিক) তিনি সে সময়ে সবিস্তারে পেশ করেন।
১. তোমার রব আদেশ করেছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা আর কারো ইবাদত করো না।
২. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো; তাঁদের একজন বা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তাঁদেরকে কখনো ‘উহ!’ (বিরক্তিসূচক) পর্যন্ত বলো না এবং কখনো তাঁদেরকে ধমক দিও না; তাঁদের সাথে সম্মানজনক ও ভদ্রজনোচিত কথা বলো। অনুকম্পায় তুমি তাঁদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বলো, ‘হে আমার রব, তাঁদের প্রতি ঠিক সেভাবেই তুমি দয়া করো, যেমনি করে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন’।
৩. আত্মীয়-স্বজনকে তাদের পাওনা আদায় করে দেবে, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদেরকেও।
৪. কখনো অপব্যয় করো না। অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের বড় অকৃতজ্ঞ।
৫. তুমি যদি তাদের (অভাবগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন ও সম্বলহীন পথিক) থেকে পাশ কেটে থাকতে চাও এ কারণে যে, তুমি তোমার রবের যে রহমত পাওয়ার আকাঙ্খী তা এখনো তালাশ করছো, তবে তাদেরকে বিনয়সূচক জবাব দাও।
৬. নিজেদের হাত গলার সাথে বেঁধে রেখো না, আবার একেবারে খোলা ও ছেড়ে দিও না-তাহলে তোমরা তিরস্কৃত ও অক্ষম হয়ে পড়বে। তোমার রব যার জন্য চান রিযিক প্রশস্ত করে দেন, আর যার জন্য চান রিযিক সংকীর্ণ করে দেন। তিনি তাঁর বান্দাহদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল আছেন ও তাদেরকে দেখছেন।
৭. দারিদ্রের ভয়ে নিজেদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমরা তাদেরকে রিযিক দিব এবং তোমাদেরকেও। বস্তুত তাদেরকে হত্যা করা একটা বড় ভুল।
৮. যিনার নিকটেও যেও না। উহা অত্যন্ত খারাপ কাজ, আর উহা অতীব নিকৃষ্ট পথ।
৯. প্রাণ হত্যার অপরাধ করো না, যাকে আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন-কিন্তু সত্যতা সহকারে। আর যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছে, তার ওলীকে আমরা কেসাস দাবী করার অধিকার দান করেছি। অতএব হত্যার ব্যাপারে যেন সীমালঙ্ঘন না করে। তাকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে।
১০. ইয়াতিমের ধনমালের কাছেও যেও না, কিন্তু অতি উত্তম পন্থায়, যতদিনে না সে তার যৌবন লাভ করে।
১১. ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে যে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
১২. পাত্র দিয়ে মাপ দিলে পুরোপুরি ভর্তি করে দিবে। আর ওজন করে দিলে ত্রুটিহীন পাল্লা দ্বারা ওজন করে দিবে। ইহা খুবই ভালো নীতি ও পরিণামের দৃষ্টিতে অতীব উত্তম।
১৩. এমন কোন জিনিসের পেছনে লেগো না, যে বিষয়ের কোন জ্ঞান তোমার নেই। নিশ্চিত জেনো চক্ষু, কান ও দিল সব কিছুকেই জবাবদিহি করতে হবে।
১৪. জমিনে বাহাদুরি করে চলো না। তোমরা না জমিনকে দীর্ণ করতে পারবে আর না পর্বতের ন্যায় উচ্চতা লাভ করতে পারবে।
রসূল সা. প্রতিষ্ঠিত মদীনার রাষ্ট্রটি মূলত এ সব মূলনীতির উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র ছিল। সকল শ্রেণির মানুষ পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে সে রাষ্ট্রে বসবাস করেছেন। আমাদের মহান রব মি’রাজের রজনীতে আমাদের সবারই এরূপ একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার তাওফিক দান করুন। আমিন