ইসলামের দৃষ্টিতে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করার বিধি-বিধান


বর্তমানে প্রায় সব মসজিদেই অনেক মুসল্লিকে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করতে দেখা যায়। কিন্তু শরিয়তের বিধান অনুযায়ী চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করাটা সঠিক হচ্ছে কিনা সেটা তাদের অনেকেই জানেন না।
অনেকের উজর-সমস্যা এতই মামুলি যে, এ ধরনের সমস্যার কারণে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করাটা বৈধ হয় না, ফলে তারা যখন চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন তখন তা সহি হয় না। একটু কষ্ট করে চেয়ার ছাড়াই তারা নামাজ আদায় করতে পারেন কিন্তু তারা সেটা না করে বরং চেয়ারে বসেই নামাজ আদায় করে যাচ্ছেন।

আর নামাজ আদায় করা সত্ত্বেও নামাজ সহি না হওয়ার কারণে তারা গোনাহগার হচ্ছেন। এজন্য এ সংক্রান্ত মাসআলা-মাসাইল বিজ্ঞ মুফতিদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেয়া একান্ত জরুরি। যাতে ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজ সহি-শুদ্ধ হয়। বক্ষমান নিবন্ধে সংক্ষেপে বিষয়টি আলোচনা করার প্রয়াস পাব।

* কিয়াম তথা দাঁড়ানো নামাজের একটি ফরজ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে তোমরা নামাজের প্রতি যত্নবান হবে। বিশেষত মধ্যবর্তী নামাজের প্রতি এবং আল্লাহর উদ্দেশে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। (বাকারা : ২৩৮)।

এ আয়াতে নামাজে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে। (বাদায়েউস সানায়ে ১/২৮৭)। দাঁড়াতে সক্ষম হলে ফরজ, ওয়াজিব ও ফজরের সুন্নাত নামাজ দাঁড়িয়েই আদায় করতে হবে। এসব নামাজ বসে আদায় করলে সহি হবে না। (শামী ২/৫৬৫)। নফল নামাজ দাঁড়াতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বসে আদায় করা জায়েজ।

(শামী বৈরোত, ২/৫৬৫)। তবে তাতে দাঁড়ানোর তুলনায় অর্ধেক সওয়াব হয়। বিষয়টি একটি হাদিসে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.) কে বসে নামাজ আদায় করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। রাসূল (সা.) বললেন, কেউ যদি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে তাহলে তা তার জন্য উত্তম। আর বসে নামাজ আদায় করলে সে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করার অর্ধেক সওয়াব পাবে। (বুখারি ১/১৫০ তিরমিযী ১/৮৫)। এ হাদিসটি নফল নামাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

কারণ দাঁড়াতে সক্ষম হলে ফরজ ওয়াজিব নামাজ বসে আদায় করা জায়েজ নয়। ইমাম তিরমিযী জামি তিরমিযীতে হাদিসটি উল্লেখ করার পর লিখেন, কতক আলেম এ হাদিসটির মর্ম সম্পর্কে বলেছেন, এটি নফলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাসান বসরি থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, কেউ ইচ্ছা করলে দাঁড়িয়ে বসে শুয়ে নফল নামাজ আদায় করতে পারবে। ‘বসে নামাজ আদায় করলে দাঁড়িয়ে আদায় করার তুলনায় অর্ধেক সওয়াব হবে’ এ হাদিসটির ব্যাখ্যায় সুফিয়ান সাওরি বলেন, যে ব্যক্তি সুস্থ, যার কোনো উজর-সমস্যা নেই এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে হাদিসটি প্রযোজ্য। অর্থাৎ নফল নামাজের ক্ষেত্রে কেউ কোনো অসুস্থতা বা উজরের কারণে বসে নামাজ আদায় করলে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ের সমান সওয়াবই পাবে।

সুফিয়ান সাওরির এ বক্তব্যের মতো বক্তব্য কিছু হাদিসেও পাওয়া যায়। (তিরমিযী ১/৮৫)। হজরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এর ইন্তিকালের এক বছর আগ পর্যন্ত আমি তাকে নফল নামাজ বসে আদায় করতে দেখিনি। ওফাতের এক বছর আগে তিনি (মাঝে মাঝে) নফল নামাজ বসে আদায় করতেন। সূরা পড়তেন স্পষ্ট করে। ধীরে ধীরে। কেরাত হতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। (তিরমিযী ১/৮৫)। দাঁড়াতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও নফল নামাজ বসে পড়লে জমিনে বসেই পড়তে হবে। চেয়ারে বসে পড়লে নামাজ সহি হবে না। জমিনে বসে হাঁটু বরাবর মাথা ঝুঁকিয়ে রুকু করতে হবে। সিজদা করতে সক্ষম হলে জমিনেই সিজদা করতে হবে। (খানিয়া ১/১৭১)।

যিনি দাঁড়াতে সক্ষম কিন্তু নিয়ম মতো রুকু সিজদা করতে অক্ষম, রুকু সিজদা করতে মারাত্মক কষ্ট হয় বা রোগ বেড়ে যায় অথবা রোগ সারতে বিলম্ব হবে এ ধরনের লোক দাঁড়িয়ে ইশারায় রুকু সিজদা করে নামাজ আদায় করবেন। জমিনে বা চেয়ারে বসে নামজ আদায় করলে নামাজ সহি হবে না। কারণ, নামজে কিয়াম বা দাঁড়ানো একটি ফরজ, অপারগতা ছাড়া তা বাদ দিলে নামজ সহি হবে না। (বদায়েউস সানায়ে ১/১০৭, মাজমাউল আনহুর ১/২২৯, তাবইনুল হাকায়েক ১/৪৯২)।
* কেউ যদি কোনো কিছুর ওপর ভর করে, হেলান দিয়ে টেক লাগিয়ে দাঁড়াতে পারেন সোজা দাঁড়াতে পারেন না তাহলে তিনি কিছুর ওপর ভর করে ঠেক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবেন। জমিনে বা চেয়ারে বসে ফরজ ওয়াজিব ও ফজরের সুন্নাত নামজ আদায় করলে সহি হবে না। (ফাতহুল কাদির ২/৩, শামী বৈরোত ২/৫৬৭)।

* যিনি কিছুক্ষণ দাঁড়াতে পারেন বেশি সময় দাঁড়াতে পারেন না। তিনি দাঁড়িয়ে নামাজ শুরু করবেন। যতক্ষণ সম্ভব দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবেন। যখন কষ্ট হবে জমিনে বসে বাকি নামাজ আদায় করবেন। রুকু সিজদা নিয়ম মতো করবেন। এমতাবস্থায় চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে নামাজ সহি হবে না।

যেমন একজন মানুষ দীর্ঘ সময় দাঁড়াতে পারে না, ফজরের নামাজে দীর্ঘ কেরাত পড়া হয় তিনি যদি জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করেন তাহলে দাঁড়িয়ে শুরু করবেন যতক্ষণ সম্ভব দাঁড়াবেন। যখন কষ্ট হবে, জমিনে বসে পড়বে। চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করতে পারবেন না। ( ফতাহুল কাদির ২/৩। শামী বৈরোত ২/৫৬৭।

* যারা দাঁড়াতে এবং রুকু সিজদা করতে অক্ষম, তারা জমিনে যেভাবে বসতে সক্ষম সেভাবে বসেই নামাজ আদায় করবেন। চেয়ারে বসে আদায় করলে নামজ সহি হবে না। জমিনে বসে ইশারায় রুকু সিজদা করতে হবে। হাঁটু বরাবর মথা ঝুঁকিয়ে ইশারায় রুকু এবং আরেকটু বেশি ঝুঁকিয়ে সিজদা করতে হবে। (বদায়েউস সানায়ে ১/২৮৪)। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে যারা দাঁড়িয়ে বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং বলে হে আমাদের প্রতিপালক তুমি এটা অনর্থক সৃষ্টি করোনি।

তুমি পবিত্র, আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর। (আলইমরান, ১৯১)। কুরতুবি বলেন, হাসান বসরিসহ আরও কয়েকজন মুফাসসির বলেছেন, আয়াতটি নামাজ সম্পর্কে অর্থাৎ (বুদ্ধিমান তারা) যারা নামাজ নষ্ট করে না। উজর হলে বসে বা শুয়ে হলেও নামাজ আদায় করে। সুতরাং আয়াত থেকে জানা গেল, নামাজ দাঁড়িয়ে আদায় করতে হবে। দাঁড়াতে সক্ষম না হলে বসে এবং তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। (তাফসিরে কুরতুবি ৪/১৯৮)। মাবসূতে সারাখসিতে রয়েছে, অসুস্থ ব্যক্তির নামাজের ব্যাপারে মূলনীতি হচ্ছে এ আয়াত- ‘যারা দাঁড়িয়ে বসে এবং শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে’ (আল ইমরান ১৯১)।

এ আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে যাহহাক বলেন, আয়াতটি হচ্ছে, অসুস্থ ব্যক্তির সামর্থ্য অনুযায়ী নামাজ আদায়ের বিবরণ। (মাবসূতে সারাখসি ১/২১২)। অপর একটি আয়াতে রয়েছে, ‘দাঁড়িয়ে বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে। (নিসা : ১০৩)। এ আয়াতে আল্লাহকে স্মরণ করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য নামাজ। অর্থাৎ তোমরা নামাজ আদায় কর। (বাদায়ে ১/২৮৪)। একটি হাদিসে বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়। হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) কে অসুস্থ ব্যক্তির নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে। তা সম্ভব নাহলে বসে আদায় করবে। তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করবে।

(বুখারি ১/১৫০, তিরমিযী, ১/৮৫, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)। এ হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝে আসে, দাঁড়ানো সম্ভব না হলে তখনই কেবল বসে নামাজ আদায় করা যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়ানো সম্ভব ততক্ষণ জমিনে বা চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে সহি হবে না। উজরের কারণে হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে ফরজ নামাজও বসে আদায় করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে অসুস্থতায় রাসূলে (সা.) ইন্তেকাল করেন সে অসুস্থতার সময় তিনি আবু বকর (রা.) এর পেছনে বসে নামাজ আদায় করেছেন। (মুসলিম, ১/১৭৭, তিরমিযী ১/৮৩)।

* যিনি জমিনে স্বাভাবিকভাবে বসতে পারেন না কিছুর সঙ্গে ঠেক লাগিয়ে বসতে পারেন তিনি কোনো কিছুর সঙ্গে ঠেক লাগিয়ে জমিনে বসেই নামাজ আদায় করবেন। যেমন মসজিদের পিলার, দেয়াল, ফ্লাটচেয়ার বালিশ ইত্যাদির সঙ্গে ঠেক লাগিয়ে জমিনে বসেই নামাজ আদায় করবেন। চেয়ারে বসে আদায় করলে নামজা সহি হবে না। (শামী ২/৫৬৫)।

* হাঁটুতে সমস্যার কারণে অনেকে হাঁটু ভাঁজ করতে পারেন না। এ ধরনের লোকের পক্ষে যদি পশ্চিম দিকে পা ছড়িয়ে জমিনে বসে সম্ভব হয় তাহলে তারা সেভাবেই নামাজ আদায় করবেন। যদি তাও সম্ভব না হয়, কোনোভাবেই তারা জমিনে বসতে না পারেন তাহলে তখনই কেবল চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা যাবে। তখন চেয়ারে বসে ইশারায় রুকু সিজদা করে নামাজ আদায় করবেন।

সিজদার জন্য রুকুর তুলনায় অধিক মাথা ঝুঁকাতে হবে। যদি কেউ কোনোভাবেই বসতে না পারেন তাহলে তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে নামাজ আদায় করবেন। পশ্চিম দিকে পা ছড়িয়ে দেবেন। ইশারায় রুকু সিজদা করবেন। যদি সম্ভব হয় তাহলে পশ্চিমদিকে পা না দিয়ে বরং হাঁটু সোজা করবেন এবং মাথার নিচে বালিশ দিয়ে দেবেন। যাতে অন্তত কিছুটা বসার মতো হয় এবং চেহারা আকাশের দিকে না হয়ে কিবলামুখী হয়। (শামী, বৈরোত, ২/৫৬৯)।

সারকথাঃ-

রুকু সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম হলে দাঁড়িয়ে ইশারায় রুকু সিজদা করে নামাজ আদায় করতে হবে। দাঁড়াতে অক্ষম হলে জমিনে বসা সম্ভব হলে জমিনে বসেই নামাজ আদায় করতে হবে। চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে সহি হবে না। যিনি কোনোভাবেই জমিনে বসতে পারেন না তিনি চেয়ারে বসে ইশারায় রুকু সিজদা করে নামাজ আদায় করবেন।



  “ গুরুত্বপূর্ণ এই পোষ্টটি শেয়ার করলে হয়তো অনেকই জানতে ও আমল করার সুযোগ পাবে। ভাই ও বোনেরা দয়া করে পোষ্টটা শেয়ার করুন ”