যিনা বা ব্যভিচার বলতে কি বোঝায় ইসলামে ?

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর।দরুদ ও সালাম আল্লাহর নবী(স) এর উপর।পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
যিনা বা ব্যভিচার বলতে বুঝায় ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক বিবাহ বন্ধন ছাড়া অবৈধ পন্থায় যৌন তৃপ্তি লাভ করাকে। ইসলামী শরীয়াতে অবৈধ পন্থায় যৌন সম্ভোগ সম্পূর্ণ হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
# রাসূল (সা) বলেছেন, ‘মানুষ তার সমগ্র ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জিনা করে। দেখা হচ্ছে চোখের জিনা,ফুঁসলানো কণ্ঠের জিনা, তৃপ্তির সাথে কথা শোনা কানের জিনা, হাত দিয়ে স্পর্শ করা হাতের জিনা, কোনো অবৈধ উদ্দেশ্যে পথ চলা পায়ের জিনা, এভাবে ব্যভিচারের যাবতীয় ভূমিকা যখন পুরোপুরি পালিত হয়, তখন লজ্জাস্থান তার পূর্ণতা দান করে অথবা পূর্ণতা দান থেকে বিরত থাকে’ (বুখারি, মুসলিম ও আবু দাউদ)।

যিনার বিধান:
-------------------
ইসলামের মূল লক্ষ্যসমুহের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হল, মানুষের ইজ্জত-আবরু ও বংশের হেফাজত করা। যিনার মাধ্যমে ইসলামের এ মহান উদ্দেশ্য বিঘ্নিত হয় বিধায় ইসলামে এটি হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং যে সব মানবিক অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে এটি তন্মধ্যে গুরুতর ও অন্যতম। ব্যভিচার একটি মহাপাপ যা অনেকগুলো অপরাধের নায়ক। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
•“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটি অশ্লীল কাজ ও অসৎ পন্থা।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩২)
তিনি অন্য স্থানে বলেন:
• “কোন রকম অশ্লীলতার কাছেও যেও না তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।” (সূরা আল-আনআম: ১৫১)
অশ্লীল কাজসমূহের মধ্যে যিনা বা ব্যভিচার সর্বাধিক অশ্লীল কাজ। ইসলাম পর্দার বিধান পালন, দৃষ্টি অবনতকরণ ও পরনারীর সাথে নির্জনে অবস্থান নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ব্যভিচারের পথ ও মাধ্যম রুদ্ধ করে দিয়েছে।


যিনাহ/ব্যভিচার ৭ টি জিনিস দিয়ে হয়:
-------------------------------------------------

(১)মন- এখান থেকেই ব্যভিচারের উৎপত্তি। যে ব্যক্তি মনের বিরুদ্ধে চলতে পারে সেই পূর্ণ ঈমানদার মুসলমান হয়।
(২)চোখ- চোখের ব্যভিচার সবচেয়ে বড় ব্যভিচার্। কারোর প্রতি অসাবধানতাবশত প্রথমবার চোখ পড়লে পাপ হয়না কিন্তু ২য় বার তাকালে বা ১ম বার দৃষ্টির পর সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে না নিলে যিনা তথা ব্যভিচার হয়।
(৩)জিহ্বা- জিহ্বা দ্বারা ব্যভিচার হয় যখন একজন নর/নারী আরেকজন নর/নারীর সাথে কথা বলে রক্ত ও স্ত্রীর সম্পর্ক ছাড়া।
(৪)কান- এটা দিয়ে ব্যভিচার হয় যখন নর/নারীর কথা শুনা হয়। রক্তের সম্পর্ক থাকলে সমাস্যা নেই।
(৫)হাত- এটা দিয়ে ব্যভিচার হয় যখন কোন বিবাহিত/ অবিবাহিত নর/নারীর শরীরের যেকোন অংশ স্পর্শ বা ধরা হয়।
(৬)পা- এটা দিয়ে ব্যভিচার হয় যখন পায়ে হেটে কাঙ্খিত কোন নর বা নারীর কাছে যাওয়া হয়।
(৭)গুপ্ত অঙ্গ- এটা দিয়েই শুধু ব্যভিচার হয় মানুষ তা ভাবলেও এটার স্থান সবার পরে। কেননা উপরে ৬ টিকে দমন করতে পারলেই এই অঙ্গ হেফাযত করা যাবে।

যিনার কুফল:
-------------------------
যিনা বা ব্যভিচারের কারণে মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বিভিন্ন ধরণের কুফল বয়ে আনে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল:

(১) যিনাকারী বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ কথা অনস্বীকার্য যে, যিনা-ব্যভিচারের মাধ্যমে প্রাণঘাতি বিভিন্ন যৌন রোগ সৃষ্টি হয় যার মধ্যে মরণঘাতি এইডস্ (এইচ, আই, ভি), সিফিলিস, গণোরিয়া, মেহ-প্রমেহ, ক্ষয়রোগ ইত্যাদি প্রধান।
(২) ব্যভিচারের কারণে যৌন সম্ভোগের বৈধ পথ রূদ্ধ হয়ে যায়; এর মাধ্যমে বিবাহ, পরিবার, সন্তানসন্তুতির প্রতি মানুষের অবজ্ঞা সৃষ্টি হয়। ফলত: আবহমান কাল ধরে চলে আসা পরিবার প্রথা ধ্বংস হতে বাধ্য হয়।
(৩) যিনা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যকার বিভেদ উঠায়ে দেয়, এ দুই শ্রেণীর মধ্যে মূল পার্থক্য হল- চতুষ্পদ জন্তুর যৌনসঙ্গমের কোন নির্দিষ্ট পরিসর নেই, কিন্তু মানুষের জন্য এ পরিসর সীমিত। তাই মানুষ যখন যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন এ পরিসরের দেয়াল টপকে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুতে পরিণত হয়। এ শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টান্ত দিয়ে আল্লাহ বলেন:
• “তারা খায় ও আনন্দ উপভোগ করে যেমন আনন্দ উপভোগ করে চতুষ্পদ জানোয়ার।” (সূরা : মুহাম্মদ ১২)

(৪) যিনাকারীর লজ্জা থাকে না। যৌন পিপাসা মিটানোর নেশায় সে সাধারণ মানবিক লজ্জা-শরম হারিয়ে ফেলে। বৈধ-অবৈধের মধ্যে কোন পার্থক্য তার কাছে আর থাকে না।
(৫) মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যিনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পতিতার উপার্জন:
---------------------
সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপার্জন হল- ব্যভিচারিণীর ঐ উপার্জন যা সে ব্যভিচারের মাধ্যমে অর্থাৎ দেহ ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করেছে। এ সম্পর্কে

# রাফে বিন খাদিজ (রা) হাদীস বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “কুকুর বিক্রিত পয়সা নিকৃষ্ট এবং যিনাকারিণীর উপার্জনও নিকৃষ্ট।” (মুসলিম)
অতএব যারা দেহ ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করে তাদের এ নিকৃষ্ট উপার্জন সম্পূর্ণভাবে হারাম, এ উপার্জন তাদের কোন উপকারে আসে না; এ অর্থ দিয়ে কোন কিছু করা হলে তা নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যায়।

যিনার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী বিষয়সমূহের হুকুম:
------------------------------------------------------
চলমান বিশ্বে ব্যভিচার ও অশ্লীলতার সমস্ত পথ উন্মুক্ত হয়ে আছে। বস্তুবাদী মানুষ যারা মনে করে এই দুনিয়াই শেষ, যতটুকু পার এখানেই আনন্দ উপভোগ করে যাও তারা মানুষকে বিপদগামী করার জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন, নারী স্বাধীনতার নামে বেহায়াপনার প্রচলনের মাধ্যমে মানব সমাজকে বিশেষত: যুবক শ্রেণীকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা নিত্যনতুন পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করছে। অশ্লীল সিনেমা, নোংরা পত্র-পত্রিকা, পর্ণ সিডি-ভিসিডি, টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইড এসবের কারণে মানুষ যিনার প্রতি বেশী ঝুকে পড়ছে। ইসলাম কোন বিষয় হারাম করলে উক্ত হারাম বিষয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী আনুষঙ্গিক বিষয়ও হারাম করে। অতএব আল্লাহর হারামকৃত যিনার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী সব কিছুই হারাম। যদি কেউ যিনা ও উচ্ছৃঙ্খল যৌন আচরণে উদ্বুদ্ধকারী বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হয় তবে ইসলামী বিধান মতে সে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধী বিবেচিত হবে।


লজ্জাস্থানের হেফাজত জান্নাতের গ্যারান্টি:
---------------------------------------------------
যারা অবৈধ যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থেকে নিজেদের লজ্জাস্থানকে অবৈধ ব্যবহার থেকে হেফাজত করে তাদের জন্য পরকালে জান্নাতের গ্যারান্টি রয়েছে। মহান আল্লাহ সফলকাম মুমিনদের পরিচয় প্রদান করতে যেয়ে বলেন:
• “আর তারা নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহকে সংযত রাখে, তাদের স্ত্রী ও তারা যাদের মালিক হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ছাড়া এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। সুতরাং কেউ এ ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমা লংঘণকারী। এবং যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী; আর যারা নিজেদের নামাযে যত্নবান থাকে। তারাই হবে উত্তরাধিকারী; উত্তরাধিকারী হবে ফেরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ী হবে।” (সূরা আল-মুমিন: ৫-১১)

# সাহাল বিন সায়াদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিস (জিহবার) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিস (যৌনাঙ্গের) নিশ্চয়তা (সঠিক ব্যবহারের) দেবে আমি তার বেহেশতের নিশ্চায়তা দিব।” (বুখারী ও মুসলিম)
যিনা-ব্যভিচার কবিরা গুনাহ। তওবা ব্যতীত এ গোনাহ মাফ হয় না ।
ব্যভিচারী ব্যক্তি ঐ গর্হিত কর্ম থেকে ফিরে এসার জন্য অনুতপ্ত হয়ে খালেছ অন্তরে তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন-ইনশাআল্লাহ।

হে আল্লাহ! আমরা তোমার নিকট দয়া, অনুগ্রহ ও দোষ-ত্র“টির গোপনীয়তা প্রার্থনা করছি এবং এমন সম্ভ্রম কামনা করছি যার বদৌলতে তুমি আমাদেরকে সকল অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করবে। আমরা তোমার নিকট আমাদের মনের পবিত্রতা ও ইযযতের হিফাযত প্রার্থনা করছি। দয়া করে তুমি আমাদের মাঝে ও হারামের মাঝে একটি পর্দা তৈরী করে দাও। আমীন!

Comments

Post a Comment