এ নির্দেশনা পাওয়া যায় ইসলাম ধর্মে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস’া।
ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর ও পবিত্র জীবনযাপনের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যবস’া করেছে। বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারী জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতামুক্ত ও নোংরামিপনার অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে স্বামী-স্ত্রী, সন-ান-সন-তির মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধিত জীবনের সন্ধান দিয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স’াপনের জন্য বিবাহ হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায় এবং মানুষের চরিত্র ও সতীত্বকে রক্ষার হাতিয়ার। বিবাহের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে সুখ-শানি- প্রতিষ্ঠা এবং পরস্পরের মধ্যে অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অপরিহার্যতা আরোপিত হয়।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তাদের অভিবাবকদের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করো, যথাযথভাবে তাদের মোহর প্রদান করো, যেন তারা বিয়ের দুর্গে সুরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে এবং অবাধ যৌনচর্চা ও গোপন বন্ধুত্বে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।’ [সূরা নিসা-২৫]।
আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের (স্বামী-স্ত্রী) একে অন্যের সাথী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন।’ [সূরা রুম-২১]।
বিশ্বব্যাপী মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান সব ধর্মের মানুষের বিয়ে নিজ নিজ ধর্ম মতে হয়ে থাকে। ধর্মের অন্য আচার-অনুষ্ঠান বা সামাজিক কর্মে সর্বক্ষেত্রে ধর্ম না থাকলেও বিয়ের সময় ধর্ম পালন করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিয়ে সম্পন্নের জন্য মাওলানা-মৌলভী, ঈমাম বা পুরোহিত ডাকা হয়ে থাকে। কিন’ বিয়ের আগে, বিয়ের সময় ও বিয়ের পরে ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের ক্ষেত্রে দেখা যায় অনীহা বরং অপব্যয়, অপসংস্কৃতি ও ধর্মে নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের ছড়াছড়ি।
বিবাহ একটি শুভ ও ধর্মীয় আইন পালনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা অনুষ্ঠান। এ জন্য বিবাহ অনুষ্ঠানে লৌকিকতা ও নিছক আনন্দ-উল্লাসের নামে বেহায়াপনার পরিবর্তে পবিত্রতা ও ধর্মীয় গাম্ভীর্যতা বজায় রাখা উচিত। রসূলুল্লাহ সা: বিবাহে এই দোয়া পাঠ করতেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের বরকত প্রদান করুন এবং তোমাদের ওপর তাঁর বরকত বর্ষিত হোক এবং তোমাদের মধ্যে মঙ্গলপ্রদ মিলন হোক। আল্লাহ তায়ালা যেন তার (স্ত্রীর) কল্যাণে তোমাকে প্রচুর অনুগ্রহ প্রদান করেন।’ [ইবনু মাজা]
বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর ওপর গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরস্পরকে সুবিবেচনার অধিকারী হয়ে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে দাম্পত্য জীবনকে সুখকর ও পবিত্র করে রাখতে হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ আর তোমরাও তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ। [সূরা বাকারাহ-১৮৭]
স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পরিপূরক। দু’জনে সব কিছুকে ভাগাভাগি করে নিয়ে চলতে হবে। একজন অন্যের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতে হবে। পোশাক যেমন মানব দেহকে আবৃত করে রেখে মানুষের নগ্নতা ও কদর্যতাকে প্রকাশ হতে দেয় না, বিভিন্ন ক্ষতিকর অবস’া থেকে রক্ষা করে থাকে, তেমনি স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করতে হয়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা কেউ স্ত্রীলোককে বিবাহ করো, তবে তার কপালের চুল ধরে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও ও শয়তানের হাত হতে মুক্তি চাও।’ [মালিক, নিকাহ, বাব-৫২]।
‘তোমাদের মধ্যে যখন কেউ কোনো স্ত্রীলোককে বিবাহ করবে তখন বলবে- হে আল্লাহ, আমি তার মঙ্গলের জন্য তোমার নিকট প্রার্থনা করি এবং তার সদিচ্ছার প্রার্থনা করি, যা তুমি সৃষ্টি করেছ। তুমি তার মধ্যে যেসব কুপ্রবৃত্তি সৃজন করেছ তা থেকে আমাকে বাঁচার জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করছি।’ [আবু দাউদ, নিকাহ, বাব-৪৪]।
ইসলামে বৈরাগ্যনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে বিয়ে করার আদেশ দেয়া হয়েছে ইসলামে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিয়ে না করা শরিয়ত বিরুদ্ধ কাজ। কেননা বিয়ে কেবল ভোগ-বিলাসের জন্য নয়, বরং বিয়ে মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলতে সহায়তা করে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা বিয়ে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম।’ [বুখারি, মুসলিম, মিশকাত হা-৩০৮০]। সা’দ ইবনু আবি ওয়াক্কাছ রা: বলেন, ‘ওছমান ইবনু মাজউনকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের অনুমতি দেননি। তাকে অনুমতি দিলে আমরা নিবীর্য হয়ে যেতাম। [বুখারি, মুসলিম, মিশকাত হা-৩০৮১]।
চরিত্র রক্ষায় অক্ষম হলে মানুষের জীবনের সফলতা বরবাদ হয়ে যায়। চক্ষুর মাধ্যমে চরিত্র ধ্বংসের সূচনা হয়ে থাকে। দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সাথে সাথে মনকে কুচিন-ামুক্ত রেখে শরীরের পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। সৎ ও অসৎ ব্যক্তি এক হতে পারে না। নেক্কার ও পাপীর মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। যাদের চরিত্র নষ্ট তাদের সাথে চরিত্রবান মানুষের কোনো সম্পর্ক করার সুযোগ ইসলামে নেই।
চরিত্রবান ও পবিত্র ব্যক্তির সাথে চরিত্রহীনা ও অপবিত্র নারীর বিবাহ করার সুযোগ নেই, তদ্রূপ চরিত্রবান নারীর সাথে চরিত্রহীন পুরুষেরও বিয়ের সুযোগ নেই। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচারী পুরুষ একমাত্র ব্যভিচারিণী নারী অথবা মুশরিক মেয়েকে বিবাহ করবে, অনুরূপ ব্যভিচারিণী নারীকে একমাত্র ব্যভিচারী পুরুষ অথবা মুশরিক পুরুষ বিবাহ করবে। মু’মিনদের জন্য ইহা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’ [সূরা নূর-৩]।
‘দুশ্চরিত্র নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য, দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্র নারীর জন্য। আর সচ্চরিত্র নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্র নারীর জন্য।’ [সূরা নূর-২৬]। ইসলামে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হলেও একাধিক বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআন মজিদে ঘোষণা করা হয়েছে, অনিবার্য পরিসি’তিতে প্রয়োজনে এক স্ত্রীর স’লে অনধিক চারজন পর্যন- স্ত্রী গ্রহণ করা যাবে। তবে যদি আশঙ্কা থাকে যে স্ত্রীদের প্রত্যেকের সাথে ব্যবহারে সমতা ও ন্যায়বিচার করতে সমর্থ হবে না, সে ক্ষেত্রে শুধু একজন স্ত্রীই গ্রহণ করতে হবে। [সূরা নিসা-৩]।
আবার বর্তমান স্ত্রীদের অনুমতি ব্যতীত আবার বিয়ে করা যায় না। একাধিক বিবাহের বিধান অপব্যবহার রোধ করতে সরকার মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ জারি করেছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস’ায় তিনি আবার বিয়ে করতে মনস’ করেন, তাকে ইউনিয়ন পরিষদের বা পৌরসভার চেয়ারম্যান বা সিটি করপোরেশন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট স’ানীয় সংস’ার অথবা তার স’লে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে আবার বিয়ের অনুমতি প্রার্থনা করে লিখিত আবেদন পেশ করতে হবে এবং ওই আবেদনে উল্লেখ থাকতে হবে যে প্রস-াবিত বিয়েতে বর্তমান স্ত্রীর বা সর্বশেষ স্ত্রীর সম্মতি রয়েছে কি না এবং স্ত্রীর বন্ধ্যত্ব, দীর্ঘস’ায়ী শারীরিক ও মানসিক অসুস’তা আছে কি না ইত্যাদি। আবেদনপ্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান দরখাস-কারী স্বামী ও তার স্ত্রীর প্রত্যেকের পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধির নাম চেয়ে তাদের কাছে পত্র লিখবেন। আবার বিয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান- প্রদানের জন্য চেয়ারম্যান ও প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত কমিটিকে সালিশি পরিষদ বলা হয়েছে। এই সালিশি পরিষদ আবেদনকারী ব্যক্তির স্ত্রী বা স্ত্রীদের শুনানি গ্রহণ করে তাদের জবানবন্দী, দরখাস-কারীর আবার বিয়ের প্রয়োজনীয়তা, যৌক্তিকতা ইত্যাদি বিষয়ে তদন- করতে সিদ্ধান- গ্রহণ করবে।’
বিবাহ একটি পবিত্র সম্পর্ক। সম্পর্ক গড়ার আগেই জেনে নিতে হবে উভয়ের মধ্যে যোগ্যতার ধরন। সমতা না থাকলে দাম্পত্য জীবনে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন জটিলতা। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের গুণাবলি বিবেচনা করা উচিত। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে তাকওয়াশীল, আল্লাহভীরু ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তোমাদের সবার চেয়ে সম্মানিত।’ [সূরা হুজরাত-১৩]।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘মেয়েদের চারটি গুণের প্রতি বিবেচনা করে বিয়ে করা হয়, তার সম্পদের প্রতি, তার বংশের মর্যাদার প্রতি, তার রূপ ও সৌন্দর্যের প্রতি এবং তার দ্বীনদারির প্রতি বিবেচনা করা হয়। কিন’ তোমরা দ্বীনদার মেয়েকেই প্রাধান্য দাও। তোমার হাত ধুলায় ধূসরিত হোক।’ [বুখারি, মুসলিম, মিশকাত হা-৩০৮২]।
ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করা পিতা-মাতার অবশ্য কর্তব্য, তেমনি তাদের যোগ্যতা হলেই বিয়ের ব্যবস’া করা পিতা-মাতার জন্য অপরিহার্য। ছেলে-মেয়েকে লালন-পালন করে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যেমন পিতা-মাতার দায়িত্ব, তেমনি তাদের সৎ পাত্রে পাত্রস’ করাও কর্তব্য।
আবু সঈদ খুদরি রা: ও ইবনু আব্বাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যার কোনো সন-ান জন্মলাভ করে সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়। যখন সে বালেগ হয় তখন যেন তার বিবাহ দেয়। যদি সে বালেগ হয় এবং তার বিবাহ না দেয় তাহলে সে কোনো পাপ করলে, সে পাপ তার পিতার ওপর বর্তাবে।’ [বায়হাকি, মিশকাত হা-৩১৩৮]