মেয়েদের বিয়ের বয়স

মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ঠিক কত ধার্য করা উচিত এবং সেটার যুক্তি ঠিক কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে এযাবৎ নানা দেশে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ উপমহাদেশে হিন্দুদের সমাজজীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে প্রধানত মনুর বিধান অনুসারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, মেয়েদের আট বছর বয়সের মধ্যেই বিবাহ দিতে হবে। হিন্দুসমাজে আট বছরবয়সী মেয়েকে বলা হয় গৌরী। ইংরেজ
শাসনামলে ১৮৯১ সালে আইন পাস হয় স্ত্রীর বয়স ১২ বছরের কম হলে স্বামী তার সাথে সহবাস করতে পারবে না। কারণ, এরচেয়ে কমবয়সী মেয়ের সাথে সহবাস করার ফলে অনেক েেত্রই স্ত্রীর মৃত্যু ঘটতে দেখা যায়। এই আইনকে বলা হয় Age of Consent বা সহবাস সম্মতি আইন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই আইন যখন পাস হয়, তখন বিলাতে ১২ বছরের কমবয়সী কোনো মেয়ে গণিকার খাতায় নাম লেখাতে পারত না। সহবাস সম্মতি আইন নিয়ে হিন্দুসমাজে প্রচুর প্রতিবাদ ওঠে। মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত হিন্দু নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক বলেন, ইংরেজরা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে হস্তপে করছে। নষ্ট করছে হিন্দু সংস্কৃতি। কিন্তু আইনটা থেকেই যায়। ১৯৫২ সালে হিন্দু কোডবিল পাস হয়। এ সময় ভারতের হিন্দু মেয়েদের নূন্যতম বিয়ের বয়স ধার্য করা হয় ১৮ এবং ছেলেদের নূন্যতম বিয়ের বয়স ধার্য করা হয় ২১। কিন্তু এই বয়স ধার্য করা হয় কোনো যুক্তি ছাড়াই। বাংলাদেশ হওয়ার পর আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ধার্য করা হয় ভারতের অনুকরণে। কিন্তু ভারতে মুসলমান বিয়েতে এই নূন্যতম বয়স প্রয়োজ্য নয়। ভারত ধর্মনিরপে রাষ্ট্র হলেও হিন্দু ও মুসলমানের েেত্র বিয়ে ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন এখনো এক হতে পারেনি। হয়ে আছে পৃথক। কিন্তু আমাদের দেশে ছেলেমেয়ের বিয়ের েেত্র আমরা হিন্দু কোডবিলের অনুকরণ করতে চেয়েছি। অবশ্য বিয়ের েেত্র আমরা অনেক পরিমাণে মেনে চলেছি শরিয়তের বিধান। এ দেশে প্রগতিশীলা মুসলিম মহিলারা দাবি করছেন, নরনারীর সমান অধিকার। কিন্তু মহিলারা ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না মোহরানার দাবি। এ েেত্র তারা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছেন মুসলিম ধ্যানধারণাকে। কেবল তা-ই নয়, এখন কোনো মুসলমান ছেলে যদি তার স্ত্রীকে মোহরানার টাকা পরিশোধ না করতে পারেন, তবে তাকে ভোগ করতে হচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিনাশ্রম কারাদণ্ড। অন্য কোনো মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে এ রকম আইন প্রচলিত আছে বলে আমাদের জানা নেই। জার্মানিতে যদি কোনো স্ত্রীর কারণে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে, তবে স্ত্রীকে বিয়েবিচ্ছেদের জন্য তিপূরণ দেয়ার বিধান আছে, যদি স্ত্রী তিপূরণ দেয়ার সমতা রাখেন। কিন্তু আমাদের দেশে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে প্রগতিশীল মহিলারা অনেক কথা বললেও বলছেন না এ রকম কোনো আইন প্রবর্তনের কথা। আমাদের দেশে নারী নির্যাতন বন্ধের জন্য কড়া আইন প্রবর্তন করা হয়েছে। আমার কিছু উকিল বন্ধু বলছিলেন আদালতে শতকরা আশি ভাগ নারী নির্যাতন মামলাই হয় মিথ্যা। এ রকম মামলা চলতে থাকলে একসময় এ দেশে বিয়েপ্রথা টিকবে না। আর তাই ছেলেমেয়েরে বিয়েসংক্রান্ত বয়স নিয়ে যে বিতর্ক তোলা হচ্ছে, থাকবে না তার কোনো প্রয়োজন। কেননা, সমাজজীবনে বিয়েব্যবস্থাই হয়ে উঠতে চাইবে অবান্তর। আমি মনে করি, মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১৪ করলে তাদের কোনো তি হবে না। শেক্সপিয়রের রোমিও জুলিয়েট নাটক খুবই খ্যাত। রোমিও যখন ভালোবেসে জুলিয়েটকে বিয়ে করতে চায়, তখন জুলিয়েটের বয়স ছিল ১৪ বছর।
ইউরোপে একসময় ১৪ বছরে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এর ফলে ইউরোপের সমাজজীবনে বিরাট বিপর্যয় নেমে এসেছে এমন নয়। নরনারীর যৌনজীবনকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গড়পড়তা মেয়েদের প্রজনন মতা ৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। একজন নারী তার জীবনে প্রায় ৪০০-এর মতো ডিম্বকোষ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু পুরুষের প্রজননমতা মেয়েদের মতো এভাবে সীমিত নয়। বুড়ো বয়সেও পুরুষের শুক্রকীট উৎপাদনমতা বন্ধ হয়ে যায় না। তাই পুরুষ ও নারীর যৌনজীবনকে একই সূত্রে বিচার করতে গেলে বড় রকমের ভুল করা হয়। মেয়েদের জীবনে পুরুষের তুলনায় বার্ধক্য আসে অনেক তাড়াতাড়ি। কিন্তু বৃদ্ধ মহিলারা গড়পড়তা বৃদ্ধ পুরুষের চেয়ে সব দেশেই বেশি হতে দেখা যায়। পৃথিবীতে বৃদ্ধের চেয়ে বৃদ্ধার সংখ্যাই বেশি। মানসিক দিক থেকেও নরনারীর বিকাশ এক রকম নয়। ছেলেদের চেয়ে ময়েরো কথা বলতে শেখে আগে। তারা সংসার সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয় ছেলেদের চেয়ে আগে। একজন মেয়ের মানসিক বয়স আর একজন ছেলের মানসিক বয়সকে এক করে দেখতে চাওয়া তাই জীববিজ্ঞানসম্মত নয়। ছেলেমেয়ের েেত্র নূন্যতম বিয়ের বয়স ঠিক করতে হলে মানবজীবনের এসব জৈব বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়িয়ে তাদের আইবুড়ি করা তাদের জন্য হবে তিকর। ছেলেদের েেত্র আইবুড়া হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বাংলা ভাষায় আইবুড়ি শব্দ আছে কিন্তু আইবুড়া বলে কোনো শব্দ নেই। বেশি বয়সের মেয়েরা সন্তানধারণে কষ্ট পান অনেক বেশি। অনেক েেত্র তাদের গর্ভজাত সন্তান হতে দেখা যায় হাবাগোবা। কারণ, তাদের জরায়ুতে ভ্রƒণ যথাযথভাবে বাড়তে পারে না। ভ্রুণের মাথার ওপর পড়ে জরায়ুর প্রাচীরের চাপ; যার ফলে বেশি বয়সের মায়েদের প্রথম সন্তান হাবাগোবা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যথেষ্ট বেশি। এ ধরনের হাবাগোবা সন্তানকে ইংরেজি ভাষায় বলে মঙ্গোলিয়ান ফিব্ল মাইন্ডেড। বেশি বয়সের মেয়েরা অনেক েেত্রই পারেন না স্বামীর সাথে খাপ খাইয়ে চলতে। ফলে বেশি বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে বিচ্ছেদ হতে দেখা দেয় বেশি। বিয়ের বয়স নিরূপণের েেত্র এসব বাস্তবতাকেও নেয়া উচিত বিবেচনায়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রগতিশীল মহিলারা বলছেন, পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই। যেটা বাস্তবতার সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সব দেশেই বিবাহিত পুরুষ তার স্ত্রীকে খেটে খাওয়াতে এখনো বাধ্য। মেয়েরা চাকরি করলেও তার স্বামীর ভরণপোষণে সহযোগিতা করতে বাধ্য নন। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব মহিলা চাকরি করেন না, গৃহকর্মেই থাকেন অধিক সময় নিয়োজিত, তাদের ইন্স্যুরেন্সে প্রিমিয়াম দিতে হয় কম। কিন্তু যারা বাইরে চাকরি করেন, তাদের ইন্স্যুরেন্সে প্রিমিয়াম দিতে হয় বেশি। কেননা তাদের জীবনে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।
অনেক বাজে কথা এবং ভুল কথা শেখানো হচ্ছে আমাদের মেয়েদের। তাদের বোঝানো হচ্ছে, ঘরের কাজ হলো ছোট কাজ। আর বাইরের বাজ হলো বড় কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে বাইরের কাজ করতে যেয়ে অনেক েেত্রই শিশুরা হচ্ছে মায়ের স্নেহ-যতœ থেকে বঞ্চিত। তারা হচ্ছে মানসিক দিক থেকে অনেক ভারসাম্যহীন। অনেক দেশেই দেখা গিয়েছে মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে। অনেক দেশে তাই শিশুদের একটি বয়স বেঁধে দেয়া হচ্ছে। যা না হলে মায়েরা  সন্তান ফেলে বাইরের কাজে যেতে পারবেন না। বিশেষ করে স্বামী যখন যথেষ্ট উপার্জন করেন। কিন্তু আমাদের দেশে এ রকম কোনো আইন করার কথা এখনো কোনো আইনপ্রণেতা ভাবছেন বলে আমার জানা নেই। বাংলাদেশে একসময় বাম চিন্তার প্রাধান্য ছিল। এখনো যার জের চলেছে। বাম চিন্তকেরা মনে করেন, একসময় সমাজে ছিল নারীর প্রাধান্য। কেননা, অর্থনীতির েেত্র ছিল নারীদের প্রাধান্য। কিন্তু এখন যেহেতু পুরুষের অর্থনৈতিক প্রাধান্য বেশি, তাই নারীদের চলতে হচ্ছে পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু অর্থনীতি দিয়ে সব কিছুর ব্যাখ্যা করা চলে না। মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। সন্তান মাতৃদুগ্ধ পান করে বড় হয়। মানবসন্তান অন্যান্য প্রাণীর শাবকের তুলনায় জন্মায় অনেক অসহায়ভাবে। তাকে মানুষ করতে হলে প্রয়োজন হয় অনেক যতেœর। যেটা কেবল মায়ের পইে সম্ভব। মানব প্রজাতির েেত্র নারীরা যদি সন্তান পালনে অবহেলা করে বাইরের কাজে মেতে উঠতে চান, তবে যেকোনো জাতির েেত্র তা হতে পারে অবলুপ্তির কারণ। সেটা কাম্য হতে পারে না। কেননা, মানুষের পারিবারিক জীবনের ল্য হলো সন্তানসন্ততির নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তার মাপকাঠিতেই বিচার্য হতে হবে অন্য আর সব কিছু।
বিয়েব্যবস্থা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো বই লিখেছেন এডওয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক। তার লেখা History of Human Marriage বইয়ে বিয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, নরনারীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ বন্ধন, যার ল্য হলো সন্তান প্রতিপালন। সন্তান প্রতিপালনের প্রয়োজন থেকেই হতে পেরেছে বিয়েবন্ধনের উদ্ভব। তিনি দেখিয়েছেন অনেক প্রাণীর মধ্যে ঠিক বিয়েবন্ধন বলে কিছু না থাকলেও থাকতে দেখা যায়, সন্তানকে রা করার জন্য স্ত্রী ও পুরুষ করছে প্রচেষ্টা। একেও বলতে হবে বিয়েবন্ধন। যেখানে সন্তান প্রতিপালনে নরনারী করে চলে সহযোগিতা, সেটাকেই মনে করা যায় বিয়েবন্ধন। যদিও সেটা হতে পারে তাদের সহজাত ধর্মপ্রসূত। আমরা বিয়ে সম্পর্কে ওয়েস্টারমার্কের দেয়া সংজ্ঞাকেই গ্রহণীয় মনে করছি।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইসলামে বাল্যবিয়ে সমর্থন করা হয় না। কেননা, ইসলামে কেবল ছেলেরা বিয়ে করে না, মেয়েরাও করে। মেয়েরা কবুল না করলে বিয়ে হতে পারে না। অর্থাৎ ইসলামে মনে করা হয়, স্বামী বেছে নেয়ার দতা হলেই মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত হয়। তবে শরিয়তে বিয়ের নূন্যতম কোনো বয়স নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। ইসলামে মেয়েদের বাবা-মায়ের এবং মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার  দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বলা হয়েছে, মেয়েরা স্বাধীনভাবে হালাল রুজি উপার্জন করতে পারবে। মেয়েদের এই উপার্জনে স্বামী হস্তপে করতে পারবে না (আল কুরআন, সূরা ৪ : ৩২)। কিন্তু ইসলামে মেয়েদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে কুটির শিল্পে। তাদের বলা হয়নি দূর বিদেশে কারাভানে যাত্রা করতে। আজকাল বাংলাদেশে সব কিছুতে ইসলামের সমালোচনা করা হয়ে উঠেছে প্রগতিশীলতার লণ। কিন্তু অর্থনীতিতে নারীর অবদান রাখার েেত্র ইসলামে কোনো বিরোধিতা করা হয়নি। কিন্তু ইসলামে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীকে অংশ নিতে উৎসাহ দেয়া হয়নি। ইসলামে নারীর মাতৃরূপের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর এই কারণেই হাদিসে বলা হয়েছেÑ মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।