ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষকের শাস্তি

বেশ কিছুদিন ধরে সংবাদপত্রে ধর্ষণের সংবাদগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। ফেইসবুক ও ব্লগাগুলোতেও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনায় আসছে। ভিন্ন শব্দ ও প্রকাশে সবার একটাই চাওয়া। ধর্ষককে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করা।
এসব আলোচনা দেখে এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখার নিয়ত করেছি। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে শুরু করছি।
ধর্ষণের সংজ্ঞা:
উইকিপিডিয়া অনুযায়ী ধর্ষণ হলো:
Rape is a type of sexual assault usually involving sexual intercourse, which is initiated by one or more persons against another person without that person’s consent.

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা ও শাস্তির যেসব বিবরণ এসেছে:
দন্ডবিধি ১৮৬০ – The Penal Code 1860: ধারা ৩৭৫-৩৭৬
A man is said to commit “rape” who except in the case hereinafter excepted, has sexual intercourse with a woman under circumstances falling under any of the five following descriptions: Firstly. Against her will.
Secondly. Without her consent.
Thirdly. With her consent, when her consent has been obtained by putting her in fear of death, or of hurt.
Fourthly. With her consent, when the man knows that he is not her husband, and that her consent is given because she believes that he is another man to whom she is or believes herself to be lawfully married.
Fifthly. With or without her consent, when she is under fourteen years of age.
Explanation. Penetration is sufficient to constitute the sexual intercourse necessary to the offence of rape.
Exception. Sexual intercourse by a man with his own wife, the wife not being under thirteen years of age, is not rape.
376. Whoever commits rape shall be punished with 131[ imprisonment] for life or with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine, unless the woman raped is his own wife and is not under twelve years of age, in which case he shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to two years, or with fine, or with both.

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এ রয়েছে:
৯৷ (১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
ব্যাখ্যা৷- যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ২[ ষোল বত্সরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ৩[ ষোল বত্সরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন৷
(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষন করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে-
(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন;
(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
টিকা দুটিতে আছে: “ষোল বত্সরের” শব্দগুলি “চৌদ্দ বত্সরের” শব্দগুলির পরিবর্তে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ (২০০৩ সনের ৩০ নং আইন) এর ৩ ধারাবলে প্রতিস্থাপিত।

ইসলামে ধর্ষণের সংজ্ঞা:
ইসলাম ধর্ষণকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। কারণ ইসলামে ধর্ষণ ভিন্ন কোনো অপরাধ নয়। বরং বিবাহবহির্ভূত যে কোনো যৌন সঙ্গমই ইসলামে অপরাধ। যাকে “যিনা” শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে।
যিনা সুস্পষ্ট হারাম এবং শিরক ও হত্যার পর বৃহত্তম অপরাধ। আল-কুরআনে আছে:
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ يَلْقَ أَثَامًا ﴿٦٨﴾ يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيهِ مُهَانًا ﴿٦٩﴾ إِلَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَٰئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا ﴿٧٠﴾
এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে। কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (ফুরকান, ৬৮-৭০)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا ﴿الإسراء: ٣٢﴾
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (ইসরা, ৩২)
ইমাম কুরতুবী বলেন, “উলামায়ে কিরাম বলেন, ‘যিনা করো না’ –এর চেয়ে ‘যিনার কাছেও যেয়ো না’ অনেক বেশি কঠোর বাক্য।”
এর অর্থ যিনার ভূমিকা যেসব বিষয়, সেগুলোও হারাম।

যিনার শাস্তি
ইসলামে যিনার শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। যিনাকারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশত ছড়ি মারা হবে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একই শাস্তি।
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ ﴿النور: ٢﴾
ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (নূর: ২)
হাদীসে আছে,
البكر بالبكر جلد مائة، ونفي سنة، والثيب بالثيب جلد مائة والرجم
অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি এক শত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশত বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড)। (সহীহ মুসলিম)
এই হাদীস থেকে অন্য ফিক্বহের ফকীহগণ বলেন, যিনাকারী অবিবাহিত হলে তার শাস্তি দুটো। ১. একশত বেত্রাঘাত। ২. এক বছরের জন্য দেশান্তর।
আর হানাফী ফকীহগণ বলেন, এক্ষেত্রে হদ (শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) হলো একশত বেত্রাঘাত। আর দেশান্তরের বিষয়টি ক্বাযী বা বিচারকের বিবেচনাধীন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে তা প্রয়োগ করতে পারেন।


ধর্ষণের শাস্তি
ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে যিনা সংঘটিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত। তাই মজলুমের কোনো শাস্তি নেই। কেবল জালিম বা ধর্ষকের শাস্তি হবে।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় সংঘটিত হয়। ১. যিনা ২. বলপ্রয়োগ/ ভীতি প্রদর্শন।

প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত যিনার শাস্তি পাবে। পরেরটির জন্য ফকীহদের একটি অংশ বলেন, মুহারাবার শাস্তি হবে।
মুহারাবা (محاربة) হলো, পথে কিংবা অন্যত্র অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার দুটোই হতে পারে।
মালেকী ফকীহগণ মুহারাবার সংজ্ঞায় সম্ভ্রম লুট করার বিষয়টিও যোগ করেছেন।
তবে সকল ফকীহই মুহারাবাকে পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, নিরাপত্তা বিঘ্নিত করণ, ত্রাস সৃষ্টি ইত্যাদি অর্থে উল্লেখ করেছেন।
মুহারাবার শাস্তি আল্লাহ এভাবে উল্লেখ করেছেন,
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَن يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم مِّنْ خِلَافٍ أَوْ يُنفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَٰلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ ﴿المائدة: ٣٣﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। (মায়িদা: ৩৩)
এখানে হত্যা করলে হত্যার শাস্তি, সম্পদ ছিনিয়ে নিলে বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দেয়া, সম্পদ ছিনিয়ে হত্যা করলে শূলীতে চড়িয়ে হত্যা করা – এরূপ ব্যখ্যা ফকীহগণ দিয়েছেন। আবার এর চেয়ে লঘু অপরাধ হলে দেশান্তরের শাস্তি দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
মোটকথা, হাঙ্গামা ও ত্রাস সৃষ্টি করে করা অপরাধের শাস্তি ত্রাস ও হাঙ্গামাহীন অপরাধের শাস্তি থেকে গুরুতর।
এ আয়াত থেকে বিখ্যাত মালেকী ফকীহ ইবনুল আরাবী ধর্ষণের শাস্তিতে মুহারাবার শাস্তি প্রয়োগের মত ব্যক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, ধর্ষক যদি বিবাহিত হয়, তাহলে এমনিতেই তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। কিন্তু সে বিবাহিত না হলে তাকে বেত্রাঘাতের পাশাপাশি বিচারক চাইলে দেশান্তর করতে পারেন। কিংবা অপরাধ গুরুতর হলে বা পুনরায় হলে অবস্থা বুঝে মুহারাবার শাস্তিও প্রদান করতে পারেন।

ইসলামের বিধানের আলোকে বাংলাদেশের ধর্ষণ আইনের পর্যালোচনা:
১. বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,
যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বত্সরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া,অথবা ষোল বত্সরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন৷
ইসলামের সাথে এই সংজ্ঞার তেমন কোনো বিরোধ নেই। তবে এতে কিছু অসামঞ্জস্যতা আছে।
ইসলাম সম্মতি-অসম্মতি উভয় ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনকে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই আইনে কেবল অসম্মতির ক্ষেত্রে তাকে অপরাধ বলা হয়েছে।
সম্মতি ছাড়া বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ইসলাম ও দেশীয় আইন উভয়ের চোখে অপরাধ। আর সম্মতিসহ সম্পর্ক ইসলামে অপরাধ, দেশীয় আইনে নয়।
এটি নৈতিকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে সম্মতি সাপেক্ষে অনুমতি দেয়া হলে মানুষ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে উৎসাহী হয়; তার চাহিদা বিস্তৃত হয়। পরে এক পর্যায়ে সে জোরপূর্বক তার চাহিদা মেটাতে সচেষ্ট হয়। আবার কোনো ক্ষেত্রে শুরুতে সম্মতি থাকলেও পরে ভিন্ন কোনো কারণে সম্মতি ছিল না বলে বলা হয়।
সম্মতি আর অসম্মতির বিভাজনরেখা খুব ঠুনকো। এর দ্বারা ধর্ষণ কখনোই রোধ করা সম্ভব নয়।
একই ব্যক্তি তার স্ত্রীভিন্ন অন্য নারীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক করে যখন পার পেয়ে যাবে, তখন সে এক পর্যায়ে জোরপূর্বকও তা করবে। চাহিদাকে সীমিত না করে ধর্ষণ রোধ করার চিন্তা অমূলক।
পক্ষান্তরে ইসলাম মানুষের চাহিদাকে সীমিত করে দেয়। বিবাহ ছাড়া কোনো নারী-পুরুষ দৈহিক সম্পর্কে জড়িতে হলেই তাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। কাজেই জোরপূর্বক করাকে অনুমোদন দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।

২. আইনে সম্মতির বিষয়টি অপরাধের সীমা হওয়ায় ষোল বছরের বয়সের কথা বলা হয়েছে, যা পূর্বে চৌদ্দ বছর ছিল এবং পরে তা সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ ষোল বছরের কম কেউ সম্মতিক্রমে দৈহিক মিলন করলেও তা দন্ডনীয় অপরাধ হবে। এবং পুরুষ শাস্তি পাবে। তবে এক্ষেত্রে নারীর কোনো শাস্তি হবে না। (অবশ্য আইনে নারীর কোনো অবস্থায়ই শাস্তি হওয়ার কথা না। ধর্ষণ হলে তো নয়ই। ধর্ষণ না হলেও নয়। কারণ ধর্ষণ না হয়ে সম্মতিক্রমে হলে কারোরই শাস্তি হবে না।)
পক্ষান্তরে ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট বয়স উল্লেখ করেনি। বরং বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ককেই যিনা বলেছে, যা দন্ডনীয় অপরাধ। এক্ষেত্রে নারীর সম্মতি থাকলে সেও শাস্তি পাবে। নতুবা পাবে না।
তবে ইসলামে যে কোনো বিধান প্রযোজ্য হওয়ার জন্য বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া জরুরী। আর বালেগ হওয়ার বয়স ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে। স্বেচ্ছায় সম্মতিতে কেউ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করলে তাকে বালেগই ধরা হবে। কাজেই তার ওপরও শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

৩. আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু না হলে তার মৃত্যুদন্ড নেই। কেবল যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড। পক্ষান্তরে ইসলামে বিবাহিত কেউ ধর্ষণ বা যিনা করলে তার শাস্তি রজম বা পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড।
আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ইসলামে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে সে প্রথমে যিনার শাস্তি পাবে। পরে হত্যার শাস্তি পাবে। হত্যা যদি অস্ত্র দিয়ে হয় তাহলে ক্বিসাস বা মৃত্যুদন্ড। আর যদি অস্ত্র দিয়ে না হয়, এমন কিছু দিয়ে হয় যা দিয়ে সাধারণত হত্যা করা যায় না, তাহলে দিয়ত বা অর্থদন্ড, যার পরিমাণ একশত উটের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (প্রায় কোটি টাকা)।
ধর্ষণের সাথে যদি আরো কিছু সংশ্লিষ্ট হয়, যেমন ভিডিও ধারণ, তা প্রচার ও প্রসার ইত্যাদি, তাহলে আরো শাস্তি যুক্ত হবে।

ইসলামে ধর্ষণ প্রমাণ করা:
যিনা প্রমাণের জন্য ইসলামে দুটোর যে কোনোটি জরুরী। ১. ৪ জন স্বাক্ষ্য ২. ধর্ষকের স্বীকারোক্তি।
তবে স্বাক্ষ্য না পাওয়া গেলে আধুনিক ডিএনএ টেস্ট, সিসি ক্যামেরা, মোবাইল ভিডিও, ধর্ষিতার বক্তব্য ইত্যাদি অনুযায়ী ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার করে স্বীকার করার জন্য চাপ দেয়া হবে। স্বীকারোক্তি পেলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করা হবে।

উপসংহার ও মন্তব্য:
ইসলামে ধর্ষণ ও যিনা, তথা সম্মতি ও অসম্মতি উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। তবে নারীর ক্ষেত্রে ধর্ষিতা হলে কোনো শাস্তি নেই, সম্মতিতে হলে শাস্তি আছে। যৌন অপরাধ নির্ণয়ে ইসলাম নির্ধারিত বিভাজনরেখা (বিবাহিত-অবিবাহিত) সর্বোৎকৃষ্ট।
বাংলাদেশের আইনে যতটুকু শাস্তি রয়েছে তা প্রয়োগে প্রশাসনের অবহেলা আর বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক চাপ প্রয়োগে ধর্ষণের উপযুক্ত শাস্তি হয় না। উপরন্তু ধর্ষিতাকে একঘরে করে রাখা হয়, তাকে সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হয়। তার পরিবারকে হুমকি-ধামকি দেয়া হয়। এগুলো কোনোটিই ইসলাম সমর্থন করে না।
ইমাম-খতীব-মুহাদ্দীস-মুফাসসির-মুফতী-ওয়ায়েজ সবারই এ বিষয়ে সচেতনতা তুলে ধরা প্রয়োজন।

Comments