ইসলামে বিয়ের লক্ষ্য বিবাহিত নর আর নারীর পবিত্র বন্ধন যেন সুখের
হয়। বিয়ের কারণে যেন কোন মানব-মানবীর জীবন দুঃখের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে
সারাজীবন নষ্ট না হয়। সেই লক্ষ্যে অসুখী দম্পতিদেরকে অসুস্থ বন্ধন থেকে
মুক্ত করতে ইসলাম তালাকের ব্যবস্থা রেখেছে। তালাক একটি জঘন্যতম বৈধ কাজ।
নবী পাক (সাঃ) ইহাকে চরমভাবে ঘৃনা করতেন। তালাক অর্থ বিবাহ বিচ্ছেদ
(Divorce)। কোন কারণ বশতঃ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হতে থাকলে যদি
চরম পর্যায়ে চলে যায় সেক্ষেত্রে
ইচ্ছা করলে তারা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে, যাকে তালাক বলা হয়। তবে
আল্লাহর কুরআনকে অতিক্রম করে নয়। আবার তালাকের জন্য দেশের আইন আছে। ইসলামী
বিধানমতে তালাক দিতে হলে স্বামীকে মুখ দিয়ে ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করতে
হয়। কিন্তু আইন অনুযায়ী তালাক শব্দ উচ্চারণ করতে হয় না। সেক্ষেত্রে উকিল বা
ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে লিখিতভাবে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন বা তালাক ঘটানো হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ধর্মীয় তালাক এবং আইনি তালাক
ভিন্ন। আইনি তালাকে মুখ দিয়ে তালাক উচ্চারণ করলে তালাক হয় না। পরবর্তীতে
যদি স্বামী-স্ত্রী চায় যে তারা আবার সংসার করবে সেক্ষেত্রে পুনরায় বিবাহ
রেজিষ্ট্রি করে আইন অনুযায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। নিঃসন্দেহে ইহাতে
কারও কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ইসলামী মতে তালাক পদ্ধতি নিয়ে মানুষের মধ্যে
বিরোধ দেখা যায়। তাই এ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
প্রকৃতপক্ষে কুরআন-হাদিস গবেষণা করলে ইসলামী বিধান মতে তালাক এবং আইনি তালাকের সাথে কোন বিরোধ পরিলক্ষিত হয় না। বিরোধ হয় শুধু কাঠমোল্লাদের অপব্যাখ্যার কারণে। আর আমারাও আছি শুধু তথাকথিত মোল্লা-মৌলভীদের ফতোয়ার আশায়। একটিবারও কুরআন-হাদিস গবেষনা করতে চেষ্টা করি না। কুরআনের মধ্যে বিজ্ঞান আছে, দর্শন আছে কিন্তু কাঠমোল্লারা বিজ্ঞানের কি বুঝবে? যদি বুঝতো তাহলে কাঠমোল্লারা প্রযুক্তি দিয়ে অনেক নতুন নতুন জিনিস আবিস্কার করতো। কিন্তু এ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক যত জিনিসই আবিস্কার হয়েছে, তাতে কোন মাদ্রাসার ছাত্র বা শিক্ষকের কোন অবদান লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও আমি মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত ছিলাম, তথাপিও সত্য স্বীকার করতে আমার বাঁধা নেই। আমি এক সময় কাঠমোল্লা ছিলাম, কিন্তু সত্য জানতে আমি সে পথ থেকে বেরিয়ে এসেছি। নিজের জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে কুরআন-হাদিস বোঝার ও গবেষণা করার চেষ্টা করি। কেননা কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, আফালা তাকিলুন অর্থাৎ ‘তোমারা গবেষণা কর’। কিন্তু আমরা গবেষণা বাদ দিয়ে শুধু অনুসরণ করি। আর কেউ নতুন কিছু আবিস্কার করলে বলি সে ইহা কুরআন গবেষণা করে আবিস্কার করেছে। অথচ আমরা কাঠমোল্লারা এ পর্যন্ত কিছুই আবিস্কার করতে পারিনি।
কুরআনে যে বিজ্ঞান আছে তার প্রমান সূরা ইয়াছিন এর ২নং আয়াতে পাই। আল্লাহ বলেন, ওয়াল কুরআনুল হাকিম অর্থাৎ কুরআন বিজ্ঞানময়। অতএব বিজ্ঞান বুঝতে হলে বিজ্ঞানের জ্ঞান লাগবে। কিন্তু মাদ্রাসায় তো বিজ্ঞানের জ্ঞান নেই। বিজ্ঞান জানতে হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেতে হবে। তাই শুধু মাদ্রসায় অধ্যয়ন করলেই কুরআন বুঝা যায় না। ফলে কুরআনে যে বিজ্ঞান আছে তার সন্ধান কাঠমোল্লারা পায়নি। তারা কুরআন গবেষণা করে শুধু তাফসীর আর ফতোয়া দিতে পারে, কোনকিছু আবিস্কার করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই সাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন,
কথাগুলো বললাম খুব কষ্টে। কেননা আমার স্কুল জীবনে দেখেছি আমার এক সহপাঠীর পিতা-মাতাকে তালাকের ফতোয়া দিয়ে কিভাবে সংসারটাকে ধ্বংস করেছে। তার বাবা একদিন তার মাকে রাগ করে বলেছিল তালাক। বাস সাথেই সাথে মসজিদের ইমাম সাহেবের কানে চলে গেল। স্বযংক্রিয় ভাবে ফতোয়া প্রস্তুত হয়ে গেল। আমার সহপাঠী খুব ভাল ছাত্র ছিল, ক্লাসে সব সময় প্রথম হতো। কিন্তু আজ সে একজন শ্রমিক হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ আমরা সব সময় বলতাম ও একদিন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। ইমাম কাঠমোল্লা ফতোয়া দিয়ে দিল তাদের তালাক হয়ে গেছে। এখন স্বামী-স্ত্রী কি করবে? ছেলে-মেয়েরা মাকে ছাড়া কেমন করে থাকবে। তাই বাবা বাড়ী হতে চলে গেলেন। যেহেতু মা এখন বেগানা নারী তাই বাবা সে বাড়ীতে আসতো না। কিছুদিন পর সে বাবা আরেকটি বিয়ে করলো। তারপরে যা ঘটে তাই ঘটতে লাগলো। বাকিটুকু আপনারা অনুধাবন করতে থাকুন। মাঝে মাঝে মনে মনে বলি হে আল্লাহ! ঐদিন যদি আমি বয়সে বড় হতাম, আজকের মত যদি সেদিন আমার কুরআন-হাদীসের জ্ঞান থাকতো তবে আমি সেই তালাকের ফতোয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতাম।
যাহোক মূল আলোচনায় আসি। আমি কুরআন ও হাদিসের আলোকে তালাক সম্পর্কে কিছু আলোচনা করবো। কুরআন ও হাদীসের আলোচনার মাধ্যমেই ইনশাআল্লাহ বোঝাতে সক্ষম হব যে, কাঠামোল্লাদের ফতোয়ার তালাক সম্পুর্ণ কুরআন ও হাদীস বিরোধী। গভীরভাবে কুরআন-হাদিস গবেষণা করলে আইনী তালাকের সাথে ধর্মীয় তালাকের কোন বিরোধ থাকে না। প্রথমেই বোঝা দরকার যে তালাক কোন পুতুল খেলা নয় যে, ইচ্ছামত পুতুল বিয়ে দিলাম আর বিয়ে ভাঙ্গলাম। তালাকের প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট সময় ব্যাপী। শুধু মুখ দিয়ে মেশিনের মত পটপট করে ‘তালাক, তালাক, তালাক’, বললেই তালাক হয় না। আর ইচ্ছা হলেও তালাক দেওয়া যায় না। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফে সূরা তালাকের মধ্যে এরশাদ করেন,
অর্থাৎ ‘হে নবী! (উম্মতকে বলুন) তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লংঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোন নতুন উপায় করে দেবেন। (সূরা তালাক, আয়াত নং-১)
অর্থাৎ ‘অতঃপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্ত পন্থায় ছেড়ে দেবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে।’ (সূরা তালাক-২)
আবার কোন নারীকে স্পর্শ করার পূর্বেই (বাসর রাতের পূর্বে) তালাক দেয়া হলে তার কোন ইদ্দত পালনের প্রয়োজন নেই। যেমন আল্লাহ এরশাদ করেন-
প্রকৃতপক্ষে কুরআন-হাদিস গবেষণা করলে ইসলামী বিধান মতে তালাক এবং আইনি তালাকের সাথে কোন বিরোধ পরিলক্ষিত হয় না। বিরোধ হয় শুধু কাঠমোল্লাদের অপব্যাখ্যার কারণে। আর আমারাও আছি শুধু তথাকথিত মোল্লা-মৌলভীদের ফতোয়ার আশায়। একটিবারও কুরআন-হাদিস গবেষনা করতে চেষ্টা করি না। কুরআনের মধ্যে বিজ্ঞান আছে, দর্শন আছে কিন্তু কাঠমোল্লারা বিজ্ঞানের কি বুঝবে? যদি বুঝতো তাহলে কাঠমোল্লারা প্রযুক্তি দিয়ে অনেক নতুন নতুন জিনিস আবিস্কার করতো। কিন্তু এ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক যত জিনিসই আবিস্কার হয়েছে, তাতে কোন মাদ্রাসার ছাত্র বা শিক্ষকের কোন অবদান লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও আমি মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত ছিলাম, তথাপিও সত্য স্বীকার করতে আমার বাঁধা নেই। আমি এক সময় কাঠমোল্লা ছিলাম, কিন্তু সত্য জানতে আমি সে পথ থেকে বেরিয়ে এসেছি। নিজের জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে কুরআন-হাদিস বোঝার ও গবেষণা করার চেষ্টা করি। কেননা কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, আফালা তাকিলুন অর্থাৎ ‘তোমারা গবেষণা কর’। কিন্তু আমরা গবেষণা বাদ দিয়ে শুধু অনুসরণ করি। আর কেউ নতুন কিছু আবিস্কার করলে বলি সে ইহা কুরআন গবেষণা করে আবিস্কার করেছে। অথচ আমরা কাঠমোল্লারা এ পর্যন্ত কিছুই আবিস্কার করতে পারিনি।
কুরআনে যে বিজ্ঞান আছে তার প্রমান সূরা ইয়াছিন এর ২নং আয়াতে পাই। আল্লাহ বলেন, ওয়াল কুরআনুল হাকিম অর্থাৎ কুরআন বিজ্ঞানময়। অতএব বিজ্ঞান বুঝতে হলে বিজ্ঞানের জ্ঞান লাগবে। কিন্তু মাদ্রাসায় তো বিজ্ঞানের জ্ঞান নেই। বিজ্ঞান জানতে হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেতে হবে। তাই শুধু মাদ্রসায় অধ্যয়ন করলেই কুরআন বুঝা যায় না। ফলে কুরআনে যে বিজ্ঞান আছে তার সন্ধান কাঠমোল্লারা পায়নি। তারা কুরআন গবেষণা করে শুধু তাফসীর আর ফতোয়া দিতে পারে, কোনকিছু আবিস্কার করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই সাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন,
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসেতাই কুরআন বুঝতে হলে ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে আধুনিক জ্ঞানও প্রয়োজন। নচেৎ কুরআন বুঝা যাবে না। আর কুরআন না বুঝলে কাঠমোল্লা হতে হবে। ফলে সমাজে ফেতনা দূরতো হবেই না, বরং আরও সৃষ্টি হবে। এই কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, কাঠমোল্লাদের না বোঝার কারণে আজ সমাজে তালাক নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এই কাঠমোল্লারা যে কত পরিবার ধ্বংস করেছে, কত ছেলে-মেয়েকে পিতা-মাতার আদর হতে দূরে রেখেছে তার হিসাব নেই। এই সমস্ত কাঠমোল্লারা যদিও নামাজ-রোজা করে তথাপিও ঐ স্ত্রীকে স্বামী হতে এবং ছেলে-মেয়েকে পিতা মাতা হতে বঞ্চিত রাখার কারণে নির্ঘাত জাহান্নামে প্রবেশ করতেই হবে। কেননা যার হক্ব নষ্ট করা হয়, সে যদি ক্ষমা না করে তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবে না। তাই যারা বান্দার হক্ব নষ্ট করবে তাদের নামাজ-রোজা কোনদিন ক্ষমা করাতে পারবে না। মিথ্যা তালাকের ফতোয়া দিয়ে যে নারীকে স্বামীর বাড়ী হতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, হিলা নামক হারাম কাজ করানো হয়েছে, ছোট ছোট সন্তানদেরকে পিতা বা মাতার কাছ থেকে দূরে রাখা হয়েছে, সেই ফতোয়ার উদ্যোক্তা, ফতোয়া প্রদানকারী এবং ফতোয়ায় সমর্থনকারী সকলকেই একদিন মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে। আল্লাহ কাঠমোল্লাদের কেনা নয়, তিনি ন্যায় বিচারক। তিনি ঐ সমস্ত ফতোয়া দানকারী কাঠমোল্লাদের বিচার অবশ্যই করবেন। যেখানে বিবাহের সময় বর-কনে উভয়ের মতামত ছাড়া বিবাহ হয় না, সেখানে কিভাবে তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক হয়ে যায়?
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি ফেকাহ হাদিস চষে।
কথাগুলো বললাম খুব কষ্টে। কেননা আমার স্কুল জীবনে দেখেছি আমার এক সহপাঠীর পিতা-মাতাকে তালাকের ফতোয়া দিয়ে কিভাবে সংসারটাকে ধ্বংস করেছে। তার বাবা একদিন তার মাকে রাগ করে বলেছিল তালাক। বাস সাথেই সাথে মসজিদের ইমাম সাহেবের কানে চলে গেল। স্বযংক্রিয় ভাবে ফতোয়া প্রস্তুত হয়ে গেল। আমার সহপাঠী খুব ভাল ছাত্র ছিল, ক্লাসে সব সময় প্রথম হতো। কিন্তু আজ সে একজন শ্রমিক হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ আমরা সব সময় বলতাম ও একদিন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। ইমাম কাঠমোল্লা ফতোয়া দিয়ে দিল তাদের তালাক হয়ে গেছে। এখন স্বামী-স্ত্রী কি করবে? ছেলে-মেয়েরা মাকে ছাড়া কেমন করে থাকবে। তাই বাবা বাড়ী হতে চলে গেলেন। যেহেতু মা এখন বেগানা নারী তাই বাবা সে বাড়ীতে আসতো না। কিছুদিন পর সে বাবা আরেকটি বিয়ে করলো। তারপরে যা ঘটে তাই ঘটতে লাগলো। বাকিটুকু আপনারা অনুধাবন করতে থাকুন। মাঝে মাঝে মনে মনে বলি হে আল্লাহ! ঐদিন যদি আমি বয়সে বড় হতাম, আজকের মত যদি সেদিন আমার কুরআন-হাদীসের জ্ঞান থাকতো তবে আমি সেই তালাকের ফতোয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতাম।
যাহোক মূল আলোচনায় আসি। আমি কুরআন ও হাদিসের আলোকে তালাক সম্পর্কে কিছু আলোচনা করবো। কুরআন ও হাদীসের আলোচনার মাধ্যমেই ইনশাআল্লাহ বোঝাতে সক্ষম হব যে, কাঠামোল্লাদের ফতোয়ার তালাক সম্পুর্ণ কুরআন ও হাদীস বিরোধী। গভীরভাবে কুরআন-হাদিস গবেষণা করলে আইনী তালাকের সাথে ধর্মীয় তালাকের কোন বিরোধ থাকে না। প্রথমেই বোঝা দরকার যে তালাক কোন পুতুল খেলা নয় যে, ইচ্ছামত পুতুল বিয়ে দিলাম আর বিয়ে ভাঙ্গলাম। তালাকের প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট সময় ব্যাপী। শুধু মুখ দিয়ে মেশিনের মত পটপট করে ‘তালাক, তালাক, তালাক’, বললেই তালাক হয় না। আর ইচ্ছা হলেও তালাক দেওয়া যায় না। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফে সূরা তালাকের মধ্যে এরশাদ করেন,
অর্থাৎ ‘হে নবী! (উম্মতকে বলুন) তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লংঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোন নতুন উপায় করে দেবেন। (সূরা তালাক, আয়াত নং-১)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
- স্ত্রীকে তালাক দিলে ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে (ইদ্দত হলো মহিলাদের রজঃস্রাব বা মাসিক চক্র)
- ইদ্দত গননা করতে হবে (কয়টি ইদ্দত গণনা করতে হবে সে সম্পর্কে কিছুক্ষন পরে আয়াত পেশ করছি)
- কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে (যিনা/ব্যভিাচার) লিপ্ত না হলে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করো না অর্থাৎ তালাক দেয়া যাবে না
- এ তিনটি বিষয় হলো আল্লাহ কর্তৃক তালাকের নির্ধারিত সীমা, যা লংঘন করলে নিজের অর্থাৎ তালাক প্রদানকারীর অনিষ্ট হবে
- উল্লেখিত তিনটি সীমা তালাকের জন্য নির্দিষ্ট। এর হেরফের হলে তালাক হবে না।
- আল্লাহ কোন নতুন উপায় করে দেবেন’ এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে মারেফুল কুরআনে বলা হয়েছে ‘স্বামীর অন্তরে তালাকের ব্যাপারে অনুতপ্ত সৃষ্টি হবে’। ফলে হয়তো তারা আবার সংসার করতে পারবে।
অর্থাৎ ‘অতঃপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্ত পন্থায় ছেড়ে দেবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে।’ (সূরা তালাক-২)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
- ইদ্দতকালে পৌছলে স্ত্রীকে রাখাও যাবে অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মিল হলে রাখা যাবে অথবা মনের অমিল হলে তালাক দিবে
- তালাকের ক্ষেত্রে দুই জন সাক্ষী রাখতে হবে। অর্থাৎ একা একা তালাক তালাক উচ্চারণ করলে তালাক হবে না। আবার পুনরায় সংসার করতে হলেও দুই জন সাক্ষী রাখতে হবে। যদি কেউ বলে তালাকের জন্য কোন স্বাক্ষীর দরকার নেই, পুরুষ তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক হবে। তবে তা সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী অর্থাৎ কুফুরী আকিদা।
এবার সূরা তালাকের ৪নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
অর্থাৎ ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।’ (সূরা তালাক-৪)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
- বালেগা নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দত কাল হবে তিন মাসিক বা তিন রজস্রাব
- নাবালেগা নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দত কাল হবে তিন মাস
- গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দতকাল হবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত
উপরোক্ত সূরা তালাকের তিনটি আয়াত বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই যে, স্পষ্ট নির্লজ্জ কাজ পরিলক্ষিত না হলে স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে না। আর তালাক দিলে সেক্ষেত্রে তিনটি ইদ্দত তথা মাসিক অপেক্ষা করতে হবে। প্রথম মাসে তালাক দিবে, যদি এর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মিল হয়ে যায় তবে তারা পুনরায় সংসার করবে। আর যদি মিল না হয় তবে দ্বিতীয় মাসে তালাক দিবে এবং অপেক্ষা করবে। যদি এবার মিল হয়ে যায় তবে সংসার করবে অথবা তৃতীয় মাসে পুনরায় তালাক দিবে। তৃতীয় মাস পূর্ণ হলে তারা যদি মনে করে সংসার করবে অথবা বিচ্ছিন্ন হবে তাহলে দুজন স্বাক্ষী রেখে চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। অর্থাৎ সংসার করলেও দুজন স্বাক্ষী রাখবে এবং বিচ্ছেদ ঘটালেও স্বাক্ষী রাখবে। তিন ইদ্দতকাল সময় অপেক্ষা করার মধ্যে হেকমত লুকিয়ে আছে। কেননা নারী যদি গর্ভবতী হয়ে যায় তবে এ তিন মাসের মধ্যেই বোঝা যাবে। আর গর্ভবর্তী নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দতকাল হবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত। অর্থাৎ তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর যদি সন্তান প্রসব না হয়, তবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কি অপার করুনা। সন্তান প্রসবের পরে যদি সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে স্বামী-স্ত্রীর মিল হয়ে যায় তাই গর্ভবতীদের জন্য আল্লাহ প্রসব পর্যন্ত ইদ্দতকাল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
এখন সূরা বাকারা ২২৮নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
অর্থাৎ ‘আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েয পর্যন্ত। আর যদি সে আল্লাহ প্রতি এবং আখেরাত দিবসের ওপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যা তার জরায়ুতে সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা জায়েয নয়। আর যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায়, তাহলে তাদেরকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার তাদের স্বামীরা সংরক্ষণ করে। আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা-২২৮)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
এ আয়াতে তালাকের জন্য নারী তিন হায়েজ বা রজঃস্রাব পর্যন্ত অপেক্ষা করবে তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে
- তালাকপ্রাপ্তা নারী তিন মাস অপেক্ষা করে অর্থাৎ চূড়ান্ত তালাকের পরে অন্য কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে
- তাৎক্ষনিক তালাক ও তাৎক্ষনিক বিবাহ সম্পুর্ণ কুরআন বিরোধী
- তিন মাসের মধ্যে জরায়ুতে যা সৃষ্টি হয়েছে তথা গর্ভবতী হলে তা প্রকাশ পাবে
- তিন মাসের মধ্যে যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায় তবে পুনরায় সংসার করতে পারে
- তালাকের ব্যাপারে পুরুষদের যেমন অধিকার আছে নারীদের ক্ষেত্রেও অধিকার আছে
এখন সূরা বাকারা ২২৯নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
অর্থাৎ “তালাকে- ‘রজঈ’ হলে দুবার পর্যন্ত- তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে। আর নিজের দেয়া সম্পদ থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয় তাদের কাছ থেকে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই এ ব্যাপারে ভয় করে যে, তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, অতঃপর যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবে উভয়ের মধ্যে কারোরই কোন পাপ নেই। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুত যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তারাই হলো জালিম।” (সূরা বাকারা-২২৯)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
- নিময় অনুযায়ী তালাক সম্পূর্ণ করতে হবে অর্থাৎ তিন ইদ্দত শেষ করে তালাক চূড়ান্ত করতে হবে (তাফসীরে জালালাইন শরীফে উক্ত আয়াতের ব্যখ্যায় তিন হায়েজে তালাক সম্পূর্ণের কথা বলা আছে)
- তালাকে রজঈ অর্থাৎ দুই তালাক তথা দুই ইদ্দত পালনের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবে
- স্ত্রীকে দেয়া সম্পদ (দেন মোহর) ফিরিয়ে নেয়া নাজায়েজ
- কোন ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি ধন-সম্পদের বিনিময়ে তালাক নেয়, সেটাও জায়েজ। স্ত্রী যদি ধন-সম্পদের বিনিময়ে স্বামীর নিকট থেকে তালাক নেয়, তবে তাকে খুলআ তালাক বলে।
এখন সূরা বাকারা ২৩১নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
অর্থাৎ “আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও, অথবা সহানুভূতির সাথে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে।” (সূরা বাকারা-২৩১)
প্রাক ইসলামী যুগে আরবে তালাকের প্রথাও ছিল। তবে সেই প্রথা ছিল সম্পূর্ণ পুরুষের দয়ার উপর। নারী চাইলেও তালাক নিতে পারতো না। এমন কি সে সময়ে স্বামী স্বৈরাচারের মত স্ত্রীর সাথে তালাক নামক অস্ত্র নিয়ে নারীর বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দিত। যেমন যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বলতো আমি তোমাকে তালাক দিলাম, সে সময়েও আরবে তালাক বলার সাথে সাথে তালাক কার্যকর হতো না। স্ত্রীকে তার মাসিকের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এমন অবস্থায় কোন অবিবেচক স্বামী স্ত্রীর মাসিক চলাকালে তার তালাক প্রত্যাহার করে নিত। এবং ঐ স্ত্রীকে ভোগ করে আবার তালাক দিত। আর এইভাবে একের পর এক নাটক করে যেত, যার কারণে ঐ নারী তার অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে কখনও মুক্তি পেতে পারতো না। তাই নারীর প্রতি এই অমানবিক জুলুমকে প্রতিহত করে নারীকে মুক্তি দিতে বাধ্য করতে উপরোক্ত আয়াতে কারীমা নাজিল হয়। উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নারীদের সম্মতিতে তাদেরকে তালাক দেয়া যাবে, তাদেরকে আটকে রাখা যাবে না এবং জ্বালাতন করা যাবে না। উক্ত আয়াতের দ্বারা ইসলাম পুরুষকে সর্বমোট ৩ দফা তালাক দেয়া বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসে, যাতে কেউ আর নারীকে নিয়ে তালাক তালাক খেলা খেলতে না পারে।আবার কোন নারীকে স্পর্শ করার পূর্বেই (বাসর রাতের পূর্বে) তালাক দেয়া হলে তার কোন ইদ্দত পালনের প্রয়োজন নেই। যেমন আল্লাহ এরশাদ করেন-
অর্থাৎ ‘হে আমানুগণ! তোমরা যখন মুমিন নারীদেরকে বিবাহ কর, অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তখন তাদের ইদ্দত পালনে বাধ্য করার অধিকার তোমাদের নেই। অতঃপর তোমারা তাদেরকে কিছু দেবে এবং উত্তম পন্থায় বিদায় দেবে।” (সূরা আহযাব-৪৯)
যাহোক, সূরা বাকারার আয়াতেও তালাকের ব্যাপারে স্পষ্টতা ফুটে উঠেছে। তা সূরা তালাকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেখানে কুরআন শরীফে তালাকের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সেখানে হাদিস শরীফ অনুসন্ধান না করলেও চলে। কেননা হাদিস দিয়ে কুরআনের আয়াত বাতিল করা যায় না। বরং কুরআনের আয়াত দিয়ে হাদিস বাতিল করা যায়। তবে আরও অধিক বোঝার স্বার্থে হাদিস শরীফ অনুসন্ধান করা যায়, যদি তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সহায়ক হয়। এবার দেখি তালাক সম্পর্কে হাদিস শরীফ কি বলে।
১. হাদিস শরীফে উলেখ আছে, রাগের বশবর্তী হয়ে অর্থাৎ রাগের মাথায় তালাক দিলে তা তালাক বলে গণ্য হবে না। যেমন আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ের ‘বাবু ফিত তালাক্বি আ’লা গাইজী’ অর্থাৎ ‘রাগান্বিত অবস্থায় তালাক দেয়া’ অনুচ্ছেদে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিস শরীফটি নিম্নরুপঃ
অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবনে উবায়দ ইবনে আবু সালিহ (র) হতে বর্ণিত, যিনি (সিরিয়ার) ইলিয়া নামক স্থানে বসবাস করতেন। তিনি বলেন, আমি সিরিয়া হতে আদী ইবনে আলী আল কিন্দীর সাথে বের হই। এরপর আমরা মক্কায় উপনীত হলে, আমাকে সাফিয়্যা বিনতে শায়বার নিকট তিনি প্রেরণ করেন। যিনি আয়শা (রা) হতে এ হাদিসটি সংগ্রহ করেন। রাবী বলেন, আমি আয়শা (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ গিলাক অবস্থায় কোন তালাক হয় না বা দাস মুক্ত করা যায় না। ইমাম আবু দাউদ (র) বলেন, গিলাক অর্থ রাগান্বিত অবস্থায় তালাক প্রদান করা। (আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৯১ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২. এছাড়া নিদ্রিত ও উন্মাদ (নেশাগ্রস্থ বা রোগগ্রস্থ) অবস্থায় তালাক হয় না। (সুনানু নাসাই শরীফ-৩য় খন্ড,-৩৪৩৩ নং হাদিস এবং সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ-২য় খন্ড-২০৪১, ২০৪২ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩. তালাক হায়েজ তথা রজঃস্রাবের সাথে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কে আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ের ‘সুন্নত তরিকায় তালাক’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে তাঁর স্ত্রীকে হায়েজ (রজঃস্রাব) অবস্থায় তালাক প্রদান করেন। তখন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) এ ব্যাপার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তুমি তাকে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে বল এবং হায়েজ হতে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাকে নিজের কাছে রাখতে বল। এরপর সে পুনরায় হায়েজ এবং পুনরায় হায়েজ হতে পবিত্র হলে সে তাকে চাইলে রাখতেও পারে এবং যদি চায় তাকে তালাক দিতে পারে, এই তালাক অবশ্য তার সাথে সহবাসের পূর্বে পবিত্রাবস্থায় দিতে হবে। আর এ ইদ্দত আল্লাহ তায়ালা নারীদের তালাক প্রদানের জন্য নির্ধারিত করেছেন।” (আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৭৬ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪. আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ে ‘আলবাত্তাতা’ অর্থাৎ এক শব্দে তিন তালাক প্রদান করা বিষয়ে উল্লেখিত আছে, “নাফি ইবনে উজায়র ইবনে আবদ ইয়াযীদ ইবনে রুকানা (রা) হতে বর্ণিত। রুকানা ইবনে আবদ ইয়ায়ীদ তাঁর স্ত্রী সুহায়মাকে ‘আলবাত্তাতা’ (এক শব্দে তিন তালাক) শব্দের দ্বারা তালাক প্রদান করে। তখন এতদসম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবহিত করা হয়। তখন তিনি বলেন, আল্লাাহর শপথ! আমি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহর শপথ, তুমি কি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করেছ? তখন জবাবে রুকানা বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করি। এতদশ্রবণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে স্বীয় স্ত্রী পুনরায় গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। অতঃপর তিনি উমার (রা) এর খিলাফতকালে তাকে দ্বিতীয় তালাক দেন এবং তৃতীয় তালাক প্রদান করেন উসমান (রাঃ) এর খিলাফত কালে।” (আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২২০৩ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
একসাথে তিন তালাক উচ্চারণকে ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় তালাকে বিদা বলে। একসাথে তিন তালাক উচ্চারণে তালাক হবে এ ধরণের কোন আইন নবীজি (সাঃ) এর সময়ে ছিল না। আসলে শারিয়ার এ আইন বানানো হয়েছে নবীজীর অনেক পরে। এ কথা বলেছেন কিছু বিশ্ববিখ্যাত শারিয়া-সমর্থকরাই। যেমন, “নবীজীর ওফাতের বহু পরে তালাকের এক নূতন নিয়ম দেখা যায়। স্বামী একসাথে তিন-তালাক উচ্চারণ করে বা লিখিয়া দেয়। এই তালাকে অনুতাপ বা পুনর্বিবেচনার সুযোগ নাই। অজ্ঞ মুসলমানেরা এইভাবে গুনাহ্ করে। নবীজী তীব্রভাবে ইহাতে বাধা দিয়াছেন” (সূত্রঃ বিশ্ব-বিখ্যাত শারিয়াবিদ ডঃ আবদুর রহমান ডোই-এর “শারিয়া দি ইসলামিক ল’ পৃঃ ১৭৯)।
“নবীজীর সময় থেকে শুরু করে হজরত আবু বকর ও হজরত ওমরের সময় পর্যন্ত একসাথে তিন-তালাক উচ্চারণকে এক-তালাক ধরা হত। কিন্তু যেহেতু লোকে তাড়াতাড়ি ব্যাপারটার ফয়সালা চাইত তাই হজরত ওমর একসাথে তিন-তালাককে বৈধ করেন এবং এই আইন চালু করেন” (সূত্রঃ আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৯৬নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং মুসলিম শরীফ, ৫ম খন্ড, ৩৫৩৮ নং হাদিস, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার)। এখানে দেখা যায় যে, নবীজি (সাঃ) এর আইনের সাথে হযরত উমর (রাঃ) এর আইনের অমিল দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হতে পারে আমরা কার আইন মান্য করবো? সোজা উত্তর নবীজি (সাঃ) এর অর্থাৎ একসাথে তিন তালাককে এক তালাক ধরবো। কেননা নবীজি (সাঃ) এক সাথে তিন তালাক অপছন্দ করতেন। যেমন-
(ক) “এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন-তালাক একসাথে দিয়েছে শুনে রাসূল (সাঃ) রাগে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঠাট্টা করছ? অথচ আমি এখনও তোমাদের মধ্যেই রয়েছি ! অনেকে এ হাদিসকে মুসলিম শরিফের সূত্রে সঠিক বলেছেন” (সূত্রঃ মওলানা মুহিউদ্দীনের বাংলা-কোরাণের তফসির পৃঃ ১২৮; মাওলানা আশরাফ আলী থানভী’র “দ্বীন কি বাঁতে” পৃঃ ২৫৪ আইন #১৫৩৭, ১৫৩৮, ১৫৪৬ ও ২৫৫৫)।
(খ) “এক সাহাবি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন-তালাক বলেছে শুনে রসুল (দঃ) বললেন ‘এই তিন তালাক মিলে হল এক-তালাক। ইচ্ছে হলে এই তালাক বাতিল করতে পার।’ (সূত্রঃ বিশ্ব-বিখ্যাত শারিয়া-সমর্থক মওলানা ওয়াহিদুদ্দিনের “Women in Islami Sharia”-তে ফতহুল বারী’র সূত্রে – পৃঃ ১০৮ ও ১০৯)
৫. ইমাম আবু দাউদ (র) বলেন, ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, “যখন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একই সাথে তিন তালাক প্রদান করবে তাতে এক তালাকাই হবে।” (আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৯৪ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
নবীজি তিন একসাথে তিন তালাককে এক তালাক ধরেছেন এবং পরবর্তীতে উমর (রা) তিন তালাককে তিন তালাকই বলে সাবস্ত্য করেছেন। ফলে তাৎক্ষণিক-তালাকে বৈপরিত্য পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে কি করতে হবে তা ইমাম শাফি’(র) বলেছেন: “পরস্পর-বিরোধী দুইটি হাদিসের মধ্যে কোন্টি বেশি নির্ভরযোগ্য তাহার বিচার অন্য সুন্নত দ্বারা বা কোরাণ দ্বারা হইবে” (সূত্রঃ ইমাম শাফি’র বিখ্যাত কেতাব “রিসালা” পৃঃ ১৮২, এটিকে সমস্ত শারিয়া বিজ্ঞানের মূল কেতাব বলে ধরা হয়)
যেহেতু একসাথে তিন তালাক উচ্চারনে নিরুৎসাহিত করা, কঠোরভাবে নিষেধ করা এবং সেটাকে এক তালাক হিসাবে গণ্য করাটাকেই অনেক বেশি সুন্নাহর কাছাকাছি। তাই আমার নবীজি (সাঃ) এর সুন্নাহ অনুসরণ করবো অর্থাৎ একসাথে তিন তালাক উচ্চারণকে এক তালাক হিসেবে সাব্যস্ত করবো। ইহাই নবীজি (সাঃ) এর আইন। খলিফা উমর (রা) এর আমলের পাঁচশত বছর পর মুসলিম জাহানে কয়েকজন উদারপন্থী ইসলামী চিন্তাবিদদের আবির্ভাব হয় তাদের মধ্যে প্রখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) ছিলেন। তিনি হাদিস কিতাব আর ইতিহাস বিশ্লেষন করে মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে মনে করিয়ে দেন যে সর্বক্ষেত্রে একসাথে তিন তালাক বলে ফেললে তালাক বৈধ হয়ে যায় না। বরং নবীজি (সাঃ) এর হাদিসের বিপরীত, যা পরিতাজ্য।
৬. আবু সাহবা (র) ইবনে আব্বাস (রা) এর নিকট এসে বললেন, হে ইবনে আব্বাস! আপনি কি জানেন না, রাসূলাহ (সাঃ) এর যুগে এবং আবু বকর ও উমর (রা) এর প্রথম যুগে তিন তালাককে এক তালাক ধরা হতো? তিনি বললেন, হ্যাঁ। (সুনানে নাসাই, ৩য় খন্ড, ৩৪০৭ নং হাদিস ও আবু দাউদ, ৩য় খন্ড, ২১৯৭ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং মুসলিম শরীফ, ৫ম খন্ড, ৩৫৩৭ নং হাদিস, বাংলাদেশ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার)
এখানেও দেখা যাচ্ছে যে, তিন তালাককে এক তালাক ধরা হয়।
৭. অনেক সময় স্বামী রাগ করে তার স্ত্রী বলে তুমি আমার জন্য হারাম। কাঠমোলারা ফতোয়া দিয়ে থাকে যে, এ কথা বলার জন্য স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে। আসলে ইহা মনগড়া। সাঈদ ইবনে যুবায়র (র) থেকে বর্ণিত। তিনি ইবনে আব্বাস (রা) কে বলতে শুনেছেন যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে হারাম বলে ঘোষনা করে তবে তাতে তালাক হয় নাা (বুখারী শরীফ, ৯ম খন্ড, ৪৮৮৮ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৮. মহিলাদের তালাকের ক্ষমতা সম্পর্কেও হাদিসে বর্ণিত আছে, “আযেশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এক সময় আমাদের তালাকের ইখতিয়ার প্রদান করেন। তখন আমরা তাঁর নির্দেশ পালন করি এবং তালাকের ইখতিয়ার সম্পর্কে কিছু ঘটেনি। অর্থাৎ কেউ তালাক গ্রহণ করেনি, বরং নবীজীর স্ত্রী হিসাবে থাকাই পছন্দ করেছেন।” (আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২২০০ নং হাদিস, সুনানে নাসাই, ৩য় খন্ড, ৩৪৪২ নং হাদিস এবং বুখারী শরীফ, ৯ম খন্ড, ৪৮৮৪, ৪৮৮৫, ও ৪৮৮৬ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। সূরা আহযাবের ২৮-২৯নং আয়াতেও নারীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা সর্ম্পকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যা এই হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বাংলাদেশে বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন আইনেও নারীরা স্বামী কর্তৃক তালাক প্রদানের ক্ষমতা পান যদি সে অপশনের কথা নিকাহ নামায় উলেখ থাকে। নিকাহনামার ১৮ নম্বর অপশনে নারীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতার ব্যাপারে উলেখ করা আছে। এ বিষয়ে বিবাহের পূর্বে নারীকে চেক করে নিতে হবে যে, তালাক দেওয়ার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে কিনা অর্থাৎ অপশনটিতে টিক দেওয়া হয়েছে কিনা?
আইনি তালাক
আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী নানা কারণে স্ত্রী আদালতে গিয়ে ডিভোর্স চাইতে পারেন। যেমন-- দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর অনুপস্থিতি (৪ বছর)
- দুই বছর পর্যন্ত টানা ভরণপোষণ না দেয়া
- স্বামী বহু বিবাহ সংক্রান্ত চুক্তি ভঙ্গ করলে
- স্বামীর যৌন অক্ষমতা
- স্বামীর সাত বছরের জেল হলে
- স্বামী কর্তৃক নির্যাতন ইত্যাদি।
মরক্কো, সিনেগাল, তিউনিসিয়া প্রভৃতি বহু মুসলিম দেশ আইন করে তাৎক্ষণিক-তালাক বেআইনি করেছে (সূত্র:
“Documenting Women’s Right Violations by Non-State Actors” by WLUML পৃঃ ৭০)। আমাদের মুসলিম আইনের ৭ নম্বর ধারা মোতাবেকও এটা বেআইনি। তফাৎটা হল ঐসব দেশে আইন ভাঙলে তার “খবর আছে,” আর আমাদের দেশে মা-বোনদের জীবন কাঠমোল্লারা ইসলামের নামে যে ধ্বংস করে তা আমাদের কানে সে আর্তনাদ, সে কান্না পৌঁছে বলে মনে হয় না। আমরা এমনই বিবেকহীন হয়ে গেছি। যে স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক-তালাকের মধ্যে পড়তে হয় তার অপমান-অসম্মান, তার ক্ষোভ-দুঃখ, তার মনের অবস্থা কবে আমরা বুঝব? মায়ের জাতিকে এ-ভাবে অসম্মান ক’রে আমরা কোনদিনই উন্নতি করতে পারব না। গ্রাম-গঞ্জের ইমাম-চেয়ারম্যানেরা এর বিরুদ্ধে কবে শক্ত হয়ে দাঁড়াবে? কবে মাদ্রাসা-শিক্ষকেরা এসব তত্ত্ব-তথ্য সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করবেন জানি না। তবে যতদিন তা না হবে ততদিনই আমাদের মা-বোনেরা জাতির চোখের সামনে নিপীড়িতা হতে থাকবেন এবং ততদিনই আমরা পিছিয়ে থাকব।
পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ তো মানুষ-ই, নবী-রসুল তো নয়। মানুষ রাগের মাথায় ভুল করতেই পারে, তাকে সে ভুল সংশোধনের সুযোগ দিয়ে ভাল মানুষ বানানোই ইসলাম। অনেক কঠিন অপরাধের তওবার সুযোগ দিয়েছে ইসলাম, দিয়েছেন রাসূল (সাঃ)। তাই, মুখ ফস্কে দু’টো কথা বের হয়ে গেলে তার আর মাফ নেই, এটা হতে পারে না। নিরপরাধ নারীর জীবন ধ্বংস করা ইসলাম-বিরোধী।
তালাকের অপব্যবহার রোধ করতে গিয়ে তালাক আইনকে কঠোর করে ফেলে হয়তো তার অপব্যবহার পুরোপুরি রোধ করা না গেলেও প্রকোপ কমিয়ে রাখা হয়েছে তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই কঠোরতার কারণেও যে হাজার মানুষের জীবন তছনছ হয়ে যায় নাই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে অপরাধ রোধে কঠোর হতে নির্দেশ দিয়েছেন তেমনি নিরপরাধী মানুষের জীবন যাপন যেন কঠোর না হয়ে যায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে বলেছেন। অবশ্যই ইসলামের এই সুন্দর বিধানের যাতে কেউ অপব্যবহার করতে না পারে তার জন্য আমাদেরকে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থ নিতে হবে।
Comments
Post a Comment