মাধবকুন্ড ঝর্ণার প্রবাহিত পানি ছুঁয়ে দেখছেন পর্যটক
মাধবকুন্ড যাওয়ার উত্তম সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। এ সময় ঝর্ণা পানিতে পূর্ণ থাকে। শীতকালেও এর সৌন্দর্য্যরে কমতি হয় না। প্রায় ২০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত এই স্থানটিতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পর্যটন সম্ভাবনা আরো বেড়েছে।
এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে পুরো এলাকাটিকে ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে ‘মাধবকুন্ড ইকোপার্ক’। শ্যামল সবুজ বনরাজি বেষ্টিত মাধবকুন্ড ইকোপার্ক, নয়নাভিরাম দৃশ্য, নান্দনিক পিকনিক স্পট, সুবিশাল পর্বতগিরি, পাহাড়ি ঝর্ণার প্রবাহিত জলরাশির কল কল শব্দ সবমিলিয়ে মাধবকুন্ড বেড়াতে গেলে পাওয়া যাবে এক আলাদা আমেজ।
মাধবকুন্ড- জলপ্রপাতের পাশেই রয়েছে কমলা বাগান। রয়েছে চা, লেবু, সুপারি ও পানের বাগান। ফলে মাধবকুন্ড বেড়াতে গেলে সহজেই ঘুরে আসা যায় এসব বাগানে। এ ছাড়া মাধবকুন্ড এলাকায় বাস করে আদিবাসী খাসিয়ারা। খাসিয়ারা ঘরে ঘরে পান চাষ করে। মাধবছড়াকে ঘিরেই খাসিয়াদের জীবনযাত্রা আবর্তিত হয়। ফলে আদিবাসী জীবনযাত্রা আর সংস্কৃতিও উপভোগ করা যাবে এখানে।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতে এলে চোখে পড়বে উঁচু নিচু পাহাড়ি টিলায় দিগন্তজোড়া চা বাগান। টিলার ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়াদের পানপুঞ্জি ও জুম চাষ। পাহাড়িদের সনাতনী বাড়ি ঘর ও জীবনযাত্রা দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। যা পর্যটকদের কেবল আনন্দই দেয়না, গবেষক ও কবি-সাহিত্যিকরা খুঁজে পান লেখার রসদ।
মাধবকুন্ড অতীত থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত। প্রতি বছরের চৈত্র মাসে মাধবেশ্বরের আশির্বাদ নিতে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মের মানুষ এখানে আসে। এ সময় মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে পুণ্যার্জন ও বারুনী স্নান করে পাপ মুক্তির কামনা করেন তারা। মাধবকুন্ডে মাধবের মন্দির ছাড়াও রয়েছে শিব মন্দির। বিশালাকার শিবলিঙ্গ পুজা করাও হয়ে থাকে। চৈত্রমাসে বিশাল মেলা বসে।
মাধবকুন্ডের নামকরণ সম্পর্কে কথিত আছে, শ্রীহট্টের রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোবর্ধন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে সেখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মাটির নীচে একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। তখন তিনি এ সন্ন্যাসীর পদ বন্দনা শুরু করলে সন্ন্যাসী নানা উপদেশসহ তাকে এ কুন্ডে মাধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেন। রাজা তা পালন করেন। সন্ন্যাসী বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিনবার মাধব, মাধব, মাধব নামে দৈববাণী হয়। সম্ভবতঃ এ থেকেই ’মাধবকুন্ড’ নামের উৎপত্তি।
আবার কারো কারো মতে মহাদেব বা শিব এর পূর্ব নাম মাধব এবং এর নামানুসারেই তার আবির্ভাব স্থানের নাম ‘মাধবকুন্ড’।
মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখার ৮ নম্বর দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের অধীন গৌরনগর মৌজার অন্তর্গত পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে এই জলপ্রপাতের স্রোতধারা বহমান। মাধবকুন্ড সিলেট সদর থেকে প্রায় ৭২ কিলোমিটার, মৌলভীবাজার জেলা থেকে ৭০ কিলোমিটার, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে ৩২ কিলোমিটার এবং কাঁঠালতলী থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
যাতায়াত, থাকা-খাওয়া : দেশের যে কোন জায়গা থেকে সড়ক পথে সরাসরি গাড়ী নিয়ে আসা যায় মাধবকুন্ডে। তা ছাড়া রেলপথেও সুবিধা আছে। ট্রেনে গেলে নামতে হবে কুলাউড়া স্টেশনে। আর সেখান থেকে মাইক্রোবাস, অটোরিকশাযোগে যেতে হবে কাঁঠালতলীতে। সেখান থেকে রিক্সা, অটো রিক্সায় বা স্কুটারে মাধবকুন্ড যেতে হবে। বড়লেখা থেকে রিক্সা ভাড়া ৭০-৮০ টাকা, স্কুটার ভাড়া জনপ্রতি ৬০-৭০ টাকা।
সেখানে পর্যটন কর্পোরেশনের ডাক বাংলোতে পূর্বানুমতি নিয়ে রাত যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া বড়লেখায়ও রয়েছে ভালো মানের হোটেল।
সর্তকতা : মাধবকুন্ড জলপ্রপাতে সৌন্দর্য্য অবলোকনের সঙ্গে রয়েছে দুর্ঘটনারও আশঙ্কা। জলপ্রপাতের মূল চূড়ায় উঠলে বা কুপের মধ্যখানে নেমে পড়লে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে মাধবকুন্ড বেড়াতে গেলে জলপ্রপাতের চূড়ায় উঠা বা লেকে সাঁতার কাটার সময় সর্তক থাকা উচিত। সাঁতার না জানলে কখনোই নামা যাবে না পানিতে।
বর্তমানে ১০টাকায় টিকেট কেটে ঝর্ণা অবলোকন করতে হয়। ভেতরে ওয়াচ টাওয়ারে উঠতে আরো ১০টাকার টিকেট নিতে হবে। এছাড়াও ভেতরে আরো অনেক কিছু রয়েছে। এগুলোতেও প্রবেশে ফি দিতে হয়। যদিও এক সময় ঝর্ণায় সাঁতার কাটা যেত। আবার ঝর্ণার উপরে উঠায় বাঁধা ছিল না। এখন এসবে প্রবেশে জরিমানা করা হয়। নিরাপত্তার জন্য চালু করা হয়েছে পর্যটন পুলিশ। তারা এখানের নিরাপত্তা বজায় রেখে চলেছে।
Comments
Post a Comment