মুহাররাম মাসঃ সহীহ হাদীস, দুর্বল হাদীস এবং জাল হাদীস।
(ক) সহীহ হাদীস
(১) এ মাসকে সহীহ হাদীসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ মাসের নফল সিয়াম সর্বোত্তম নফল সিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
أفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ
“রামাদানের পরে সর্বোত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুর্হারাম মাস।” মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২১।
(১) এ মাসকে সহীহ হাদীসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ মাসের নফল সিয়াম সর্বোত্তম নফল সিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
أفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ
“রামাদানের পরে সর্বোত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুর্হারাম মাস।” মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২১।
(২) এ মাসের ১০ তারিখ ‘আশূরা’র দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। আশূরার সিয়াম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ
“এ দিনের সিয়াম গত এক বছরের পাপ মার্জনা করে।” মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১৯।
এ দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে সিয়াম পালন করতেন, তাঁর উম্মাতকে সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন এবং ১০ তারিখের সাথে সাথে ৯ বা ১১ তারিখেও সিয়াম পালন করতে উৎসাহ দিয়েছেন। ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৬৮-৭৬; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯১-৯৪।
يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ
“এ দিনের সিয়াম গত এক বছরের পাপ মার্জনা করে।” মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১৯।
এ দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে সিয়াম পালন করতেন, তাঁর উম্মাতকে সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন এবং ১০ তারিখের সাথে সাথে ৯ বা ১১ তারিখেও সিয়াম পালন করতে উৎসাহ দিয়েছেন। ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৬৮-৭৬; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯১-৯৪।
(৩) সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, এ দিনে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল মূসা (আ) ও তাঁর সঙ্গী বনী ইসরাঈলকে র্ফিআউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন এবং ফির‘আউন ও তার সঙ্গীদেরকে ডুবিয়ে মারেন। বুখারী, আস-সহীহ ২/৭০৪, ৩/১২৪৪; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৯৬।
(খ) অত্যন্ত দুর্বল হাদীস ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্য
সহীহ হাদীস থেকে মুর্হারাম মাস ও আশুরা সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানা যায়। পরবর্তীকালে অনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী এক্ষেত্রে প্রচলিত হয়েছে। এজাতীয় প্রচলিত কথাবার্তাকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি: (১) যে সকল ‘হাদীস’ কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করলেও, কেউ কেউ তা দুর্বল হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং যে সকল ‘হাদীস’ অত্যন্ত দুর্বল সনদে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যত ইসরাঈলী বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁরা এগুলি বলেছেন। (২) সকল মুহাদ্দিস যে সকল হাদীসকে ‘জাল’ ও ভিত্তিহীন বলে একমত পোষণ করেছেন।
প্রথম পর্যায়ের কিছু হাদীস ও মতামত:
১. এ দিনে আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-এর তাওবা কবুল করেন।
২. এ দিনে নূহ (আ) এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামে।
৩. এ দিনে ঈসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন।
৪. আশূরার দিনে দান-সাদকার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তবে অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে একজন সাহাবী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বছরের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেহেতু এ দিনে দান করলেও এক বছরের দানের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এ দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা।
৫. আশুরার দিনে ভাল খাওয়া-পরা। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ فِيْ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ، وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ فِيْ سَنَتِهِ كُلِّهَا
“যে ব্যক্তি আশূরার দিনে তার পরিবারের জন্য প্রশস্তভাবে খরচ করবে, আল্লাহ সারা বছরই সে ব্যক্তিকে প্রশস্ত রিয্ক প্রদান করবেন।”
হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। বিভিন্ন সনদের কারণে বাইহাকী, ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ হিসেবে গণ্য না করে ‘দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে ‘অত্যন্ত আপত্তিকর ও খুবই দুর্বল’ বলেছেন। অপরদিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইবনু তাইমিয়া প্রমুখ মুহাদ্দিস একে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, প্রত্যেক সনদই অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার ফলে একাধিক সনদে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় না। এছাড়া হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদীরা আশুররা দিনে উৎসব- আনন্দ করে- তোমরা তাদের বিরোধিতা করবে, এ দিনে সিয়াম পালন করবে এবং উৎসব বা আনন্দ করবে না।
৬. আশূরার দিনে সুরমা ব্যবহার। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنِ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ بِالإِثْمِدِ، لَمْ تَرْمُدْ عَيْنُهُ أَبَداً
“যে ব্যক্তি আশূরার দিনে চোখে ‘ইসমিদ’ সুরমা ব্যবহার করবে কখনোই তার চোখ উঠবে না।”
উপরের হাদীসটির মতই এ হাদীসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেই অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে ‘দুর্বল’ হিসাবে গণ্য করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট হিসাবে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন, ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীগণ আশুরার দিনে সুরমা মাখার বিদ‘আতটি চালু করেন। এ কথাটি তাদেরই বানানো। কোনো দুর্বল রাবী বেখেয়ালে তা বর্ণনা করেছেন।
(গ) মুহাররাম মাস বিষয়ক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা
এগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি: প্রথম, আশুরার সিয়ামের ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা, দ্বিতীয়, বিশেষ সালাত ও তার ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা এবং তৃতীয়, আশুরার দিনে অতীত ও ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে বলে জাল কথা।
১. আশুরার সিয়ামের ফযীলত
(ক) “যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন।
(খ) “যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে।”
(গ)“ যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাইবে, আল্লাহতাআলা ঐ এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’ প্রদান করিবেন। আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ও ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।... তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে।... (হাদীস)”
অনুরূপ আরেকটি মিথ্যা কথা: “হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। ... মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।... তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন... মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম (আ) ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে ...।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট কথা ও জাল হাদীস।
২. মুর্হারাম মাসের সালাত
মুর্হারাম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মুর্হারাম মাসের ১ম তারিখে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করে বিশেষ দোয়া পাঠের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৩. আশুরার দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত
আশুরার সিয়ামের উৎসাহ দেয়া হলেও, হাদীসে আশুরার দিনে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ অনেক কথা বানিয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে ... অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে ... সে এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ আলিম ও বুযুর্গকেও ধোঁকা দিয়েছে।
৪. আশুরায় অতীত ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তি
মিথ্যাবাদীরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নামে জালিয়াতি করে বলেছে:
১. আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।
২. এ দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদনদী.... সৃষ্টি করেছেন।
৩. এ দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন।
৪. এ দিনে তিনি লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন।
৫. এ দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন।
৬. এ দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন।
৭. এ দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন।
৮. এ দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন।
৯. এ দিনে তিনি জিবরাঈলকে (আ) সৃষ্টি করেছেন।
১০. এ দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন।
১১. এ দিনে তিনি আদমকে (আ) সৃষ্টি করেছেন।
১২. এ দিনে তিনি আদমকে (আ) জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
১৩. এ দিনে তিনি ইদরীসকে (আ) আসমানে উঠিয়ে নেন।
১৪. এ দিনে তিনি নূহ (আ)-কে নৌকা থেকে বের করেন।
১৫. এ দিনে তিনি দায়ূদের (আ) তাওবা কবুল করেছেন।
১৬. এ দিনে তিনি সুলাইমান (আ)-কে রাজত্ব প্রদান করেছেন।
১৭. এ দিনে তিনি আইঊব (আ)-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন।
১৮. এ দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন।
১৯. এ দিনে ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন... খলীল উপাধি লাভ করেন।
২০. এ দিনে ইবরাহীম (আ) নমরূদের অগ্নিকুণ্ডু থেকে রক্ষা পান।
২১. এ দিনে ইসমাঈল (আ) কে কুরবানী করা হয়েছিল।
২২. এ দিনে ইউনূস (আ) মাছের পেট থেকে বাহির হন।
২৩. এ দিনে আল্লাহ ইউসূফকে (আ) জেলখানা থেকে বের করেন।
২৪. এ দিনে ইয়াকুব (আ) দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান।
২৫. এ দিনে ইয়াকূব (আ) ইউসূফের (আ) সাথে সম্মিলিত হন।
২৬. এ দিনে মুহাম্মাদ () জন্মগ্রহণ করেছেন।
২৭. এ দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে....।
কেউ কেউ বানিয়েছে: মুর্হারামের ২ তারিখে নূহ (আ) প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন, ৩ তারিখে ইদরীসকে (আ) আসমানে উঠানো হয়েছে, ৪ তারিখে ইবরাহীমকে (আ) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরূপ অগণিত ঘটনা এ মাসে বা এ দিনে ঘটেছে এবং ঘটবে বলে উল্লেখ করেছে জালিয়াতরা তাদের এ সকল কল্প কাহিনীতে। মোট কথা হলো, আশুরার দিনে মূসা (আ) ও তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আদমের (আ) এর তাওবা কবুল, নূহ (আ) এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামা ও ঈসা (আ) জন্মগ্রহণ করার কথা অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে বর্ণিত। আশুরা বা মুর্হারাম সম্পর্কে আর যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা ও বাতিল কথা। দুঃখজনক হলো, আমাদের সমাজে মুর্হারাম বা আশূরা বিষয়ক বই পুস্তকে, আলোচনা ও ওয়াযে এ সমস্ত ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করা হয় ।
সহীহ হাদীস থেকে মুর্হারাম মাস ও আশুরা সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানা যায়। পরবর্তীকালে অনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী এক্ষেত্রে প্রচলিত হয়েছে। এজাতীয় প্রচলিত কথাবার্তাকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি: (১) যে সকল ‘হাদীস’ কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করলেও, কেউ কেউ তা দুর্বল হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং যে সকল ‘হাদীস’ অত্যন্ত দুর্বল সনদে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যত ইসরাঈলী বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁরা এগুলি বলেছেন। (২) সকল মুহাদ্দিস যে সকল হাদীসকে ‘জাল’ ও ভিত্তিহীন বলে একমত পোষণ করেছেন।
প্রথম পর্যায়ের কিছু হাদীস ও মতামত:
১. এ দিনে আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-এর তাওবা কবুল করেন।
২. এ দিনে নূহ (আ) এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামে।
৩. এ দিনে ঈসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন।
৪. আশূরার দিনে দান-সাদকার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তবে অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে একজন সাহাবী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বছরের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেহেতু এ দিনে দান করলেও এক বছরের দানের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এ দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা।
৫. আশুরার দিনে ভাল খাওয়া-পরা। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ فِيْ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ، وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ فِيْ سَنَتِهِ كُلِّهَا
“যে ব্যক্তি আশূরার দিনে তার পরিবারের জন্য প্রশস্তভাবে খরচ করবে, আল্লাহ সারা বছরই সে ব্যক্তিকে প্রশস্ত রিয্ক প্রদান করবেন।”
হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। বিভিন্ন সনদের কারণে বাইহাকী, ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ হিসেবে গণ্য না করে ‘দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে ‘অত্যন্ত আপত্তিকর ও খুবই দুর্বল’ বলেছেন। অপরদিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইবনু তাইমিয়া প্রমুখ মুহাদ্দিস একে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, প্রত্যেক সনদই অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার ফলে একাধিক সনদে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় না। এছাড়া হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদীরা আশুররা দিনে উৎসব- আনন্দ করে- তোমরা তাদের বিরোধিতা করবে, এ দিনে সিয়াম পালন করবে এবং উৎসব বা আনন্দ করবে না।
৬. আশূরার দিনে সুরমা ব্যবহার। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنِ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ بِالإِثْمِدِ، لَمْ تَرْمُدْ عَيْنُهُ أَبَداً
“যে ব্যক্তি আশূরার দিনে চোখে ‘ইসমিদ’ সুরমা ব্যবহার করবে কখনোই তার চোখ উঠবে না।”
উপরের হাদীসটির মতই এ হাদীসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেই অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে ‘দুর্বল’ হিসাবে গণ্য করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট হিসাবে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন, ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীগণ আশুরার দিনে সুরমা মাখার বিদ‘আতটি চালু করেন। এ কথাটি তাদেরই বানানো। কোনো দুর্বল রাবী বেখেয়ালে তা বর্ণনা করেছেন।
(গ) মুহাররাম মাস বিষয়ক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা
এগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি: প্রথম, আশুরার সিয়ামের ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা, দ্বিতীয়, বিশেষ সালাত ও তার ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা এবং তৃতীয়, আশুরার দিনে অতীত ও ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে বলে জাল কথা।
১. আশুরার সিয়ামের ফযীলত
(ক) “যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন।
(খ) “যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে।”
(গ)“ যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাইবে, আল্লাহতাআলা ঐ এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’ প্রদান করিবেন। আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ও ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।... তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে।... (হাদীস)”
অনুরূপ আরেকটি মিথ্যা কথা: “হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। ... মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।... তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন... মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম (আ) ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে ...।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট কথা ও জাল হাদীস।
২. মুর্হারাম মাসের সালাত
মুর্হারাম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মুর্হারাম মাসের ১ম তারিখে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করে বিশেষ দোয়া পাঠের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
৩. আশুরার দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত
আশুরার সিয়ামের উৎসাহ দেয়া হলেও, হাদীসে আশুরার দিনে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ অনেক কথা বানিয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে ... অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে ... সে এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ আলিম ও বুযুর্গকেও ধোঁকা দিয়েছে।
৪. আশুরায় অতীত ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তি
মিথ্যাবাদীরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নামে জালিয়াতি করে বলেছে:
১. আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।
২. এ দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদনদী.... সৃষ্টি করেছেন।
৩. এ দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন।
৪. এ দিনে তিনি লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন।
৫. এ দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন।
৬. এ দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন।
৭. এ দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন।
৮. এ দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন।
৯. এ দিনে তিনি জিবরাঈলকে (আ) সৃষ্টি করেছেন।
১০. এ দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন।
১১. এ দিনে তিনি আদমকে (আ) সৃষ্টি করেছেন।
১২. এ দিনে তিনি আদমকে (আ) জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
১৩. এ দিনে তিনি ইদরীসকে (আ) আসমানে উঠিয়ে নেন।
১৪. এ দিনে তিনি নূহ (আ)-কে নৌকা থেকে বের করেন।
১৫. এ দিনে তিনি দায়ূদের (আ) তাওবা কবুল করেছেন।
১৬. এ দিনে তিনি সুলাইমান (আ)-কে রাজত্ব প্রদান করেছেন।
১৭. এ দিনে তিনি আইঊব (আ)-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন।
১৮. এ দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন।
১৯. এ দিনে ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন... খলীল উপাধি লাভ করেন।
২০. এ দিনে ইবরাহীম (আ) নমরূদের অগ্নিকুণ্ডু থেকে রক্ষা পান।
২১. এ দিনে ইসমাঈল (আ) কে কুরবানী করা হয়েছিল।
২২. এ দিনে ইউনূস (আ) মাছের পেট থেকে বাহির হন।
২৩. এ দিনে আল্লাহ ইউসূফকে (আ) জেলখানা থেকে বের করেন।
২৪. এ দিনে ইয়াকুব (আ) দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান।
২৫. এ দিনে ইয়াকূব (আ) ইউসূফের (আ) সাথে সম্মিলিত হন।
২৬. এ দিনে মুহাম্মাদ () জন্মগ্রহণ করেছেন।
২৭. এ দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে....।
কেউ কেউ বানিয়েছে: মুর্হারামের ২ তারিখে নূহ (আ) প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন, ৩ তারিখে ইদরীসকে (আ) আসমানে উঠানো হয়েছে, ৪ তারিখে ইবরাহীমকে (আ) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরূপ অগণিত ঘটনা এ মাসে বা এ দিনে ঘটেছে এবং ঘটবে বলে উল্লেখ করেছে জালিয়াতরা তাদের এ সকল কল্প কাহিনীতে। মোট কথা হলো, আশুরার দিনে মূসা (আ) ও তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আদমের (আ) এর তাওবা কবুল, নূহ (আ) এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামা ও ঈসা (আ) জন্মগ্রহণ করার কথা অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে বর্ণিত। আশুরা বা মুর্হারাম সম্পর্কে আর যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা ও বাতিল কথা। দুঃখজনক হলো, আমাদের সমাজে মুর্হারাম বা আশূরা বিষয়ক বই পুস্তকে, আলোচনা ও ওয়াযে এ সমস্ত ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করা হয় ।
Comments
Post a Comment