সন্তান লাভের আশায় কোনো দম্পতি কোনো প্রকার গর্ভনিরোধক উপায় অবলম্বন না করে এক বছর স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনযাপনের পরও যখন স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার না হয় তখন তাকে বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। সন্তান স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার এক মজবুত সেতুবন্ধ, দাম্পত্য জীবন এতে পূর্ণতা পায়। দেখা গেছে যে, ছয় মাস এক সাথে সহবাসের পর ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এবং এক বছর পর ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে মহিলারা গর্ভধারণ করে থাকেন।
সন্তান লাভের আশায় কোনো দম্পতি কোনো প্রকার গর্ভনিরোধক উপায় অবলম্বন না করে এক বছর স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনযাপনের পরও যখন স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার না হয় তখন তাকে বন্ধ্যাত্ব বলা হয়।
সন্তান স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার এক মজবুত সেতুবন্ধ, দাম্পত্য জীবন এতে পূর্ণতা পায়। দেখা গেছে যে, ছয় মাস এক সাথে সহবাসের পরস্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার এক বছরের মধ্যে সন্তানসম্ভাবনা না ঘটলে ত্রুটি স্বামী বা স্ত্রী অথবা উভয়েরই থাকতে পারে। ডব্লিউএইচও’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার ৮-১০ শতাংশ দম্পতি কোনো-না-কোনো ধরনের বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে এর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা একই রকম হবে।
ক. শুক্রাণুর উৎপাদন সমস্যাÑ যা হতে পারে গুণগত বা সংখ্যাগত
খ. উৎপাদিত মানসম্পন্ন শুক্রাণু নিঃসরণে অক্ষমতা এবং
গ. ইমিউনোলজিক্যাল সমস্যা ।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি যেমন শুক্রাশয় শুক্রথলিতে না থাকলে বন্ধ্যত্ব হতে পারে। শুক্রাণু তৈরির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং তাপমাত্রার প্রযোজ্য হয়, শুক্রথলিতে এই তাপমাত্রা বজায় থাকে। জন্মগত কারণে শুক্রাশয়, শুক্রথলিতে না থাকলে শুক্রাণু তৈরির সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকে না এবং শুক্রাণু তৈরিপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
পুরুষের ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের আর একটি অন্যতম কারণ হলো, ইনফেকশন। মাম্পস, ইনফুয়েঞ্জা, গনোরিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজ করা, গরমপানিতে গোসল করা অথবা নাইলনের তৈরী অন্তর্বাসের ব্যবহার শুক্রাণু তৈরির প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, কারণ শুক্রাণু তৈরির উপযুক্ত তাপমাত্রা এতে বজায় থাকে না।
অতিরিক্ত ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, মাদকদ্রব্য যেমনÑ কোকেইন সেবন, কোনো কোনো ব্লাড প্রেসারের ওষুধ যেমন নিফিডিপিন শুক্রাণুর ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয় এবং বন্ধ্যত্বের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুক্রথলির অপারেশন যেমন হার্নিয়া, হাইড্রোসিল অপারেশন, শুক্রথলিতে আঘাত লাগা, এক্স-রে ইত্যাদি পুরুষের বন্ধ্যত্ব কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ছাড়া পুরুষের ক্ষেত্রে হরমোনজনিত সমস্যা এবং জেনেটিক সমস্যাও বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের কারণ ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণু তৈরির জটিলতা মেয়েদের বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ।
দেখা গেছে ২০-২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এই সমস্যা মেয়েদের বন্ধ্যত্বের জন্য দায়ী। এ ছাড়া থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ, পলিসিস্টিক ওভারি বা ওভারির সিস্ট, ডায়াবেটিস ইত্যাদি বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। মেয়েদের প্রজননতন্ত্রের জন্মগত, গঠনগত ত্রুটি, ফ্যালোপিয়ান টিউবে বাধা, এন্ড্রোমেট্রিওসিস, অধিক প্রল্যাকটিন হরমোন তৈরি, জরায়ুর ইনফেকশন, জরায়ুর টিউমার অনুর্বরতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত। শুধু স্বামী বা স্ত্রীর প্রজনন অঙ্গের নানা ত্রুটি বা অসুখ নয় আরো নানা বিষয় আছে যার কারণে বন্ধ্যত্ব হতে পারে।
যেমন বয়স যা পুরুষের চেয়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। মেয়েদের বেলায় ২৫-৩০ বছর বয়স সন্তান জন্মদানের উপযুক্ত সময়। বয়সের সাথে সাথে বন্ধ্যত্বের সমস্যাগুলো জটিল হয়। যত বয়স বাড়তে থাকে ডিম্বাণুর সংখ্যা তত কমতে থাকে। এই ডিম্বাণু হ্রাসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ত্রিশ বছর বয়স থেকে এবং ডিম্বাণু হ্রাসের প্রক্রিয়া দ্রুত হয় চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে। বয়সের সাথে ডিম্বাণুর কোয়ালিটি নষ্ট হতে থাকে, সেই সাথে দেখা দেয় জেনেটিক নানা ত্রুটি। কাজেই বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে বয়স ৩৫ এর কাছাকাছি হলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
বয়স ছাড়াও স্বামী বা স্ত্রীর শরীর অস্বাভাবিক মোটা হলে, মানসিক কারণে শারীরিক মিলনে লজ্জা বা ভয় বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। বৈবাহিক জীবনে অশান্তি বা দ্বন্দ্বের জন্য শারীরিক সম্পর্ক অনিয়মিত বা সময়মতো না হলে গর্ভসঞ্চার না-ও হতে পারে।
অনেক সময় স্বামী ও স্ত্রী ভিন্ন জায়গায় থাকেন, কাজেই যখন গর্ভধারণের সময় এক সাথে থাকা হয় না। এটাও বন্ধ্যত্বের একটা কারণ হতে পারে। প্রতিটি বন্ধ্যাত্বের সঠিক কারণটি নানা রকম আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনুসন্ধান করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর সঠিক চিকিৎসা দেয়া যায়। বন্ধ্যত্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা পুরুষের ক্ষেত্রে সিমেন (বীর্য) পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
সিমেন পরীক্ষার রিপোর্ট যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে স্বামীর উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যা নেই বলা যেতে পারে। মূলত সিমেনে উপযুক্ত পরিমাণে গতিশীল স্পার্মের অভাবই পুুরুষের ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের প্রধান কারণ। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষের বীর্যে সময়ের সাথে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গতিশীলতার তারতম্য হতে পারে। যদি সিমেন পরীক্ষায় ইনফেকশনের লক্ষণ থাকে তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা দরকার হয়।
এ ছাড়া ধূমপান, অ্যালকোহল হতে বিরত থাকা, ওজন কমানো, ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণ রাখা ইত্যাদি সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, সর্বোপরি সুস্থ জীবনযাপন বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকলে IUI একটি উপযুক্ত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ডিম্বাণু নিঃসরণের সময় জরায়ুর ভেতরে স্বামীর বীর্য বিশেষভাবে প্রসেসিংয়ের পর সূক্ষ্ম ক্যাথেটারের মাধ্যমে দিয়ে দেয়া হয়। তবে শুক্রাণুর সংখ্যা পাঁচ মিলিয়নের নিচে বা শুক্রাণুর গঠনগত ত্রুটি থাকলে বা নড়াচড়া কম থাকলে ইকসি (ICSI) দরকার হয়। ইকসি পদ্ধতিতে একটি ডিম্বাণুর মধ্যে একটি সুস্থ শুক্রাণু ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে ডিম্বাণু নিষিক্ত করা হয়। যেসব পুরুষের ক্ষেত্রে বীর্যবাহী নালীতে বাধা থাকে তাদের বেলায় সার্জিক্যাল-পদ্ধতির মাধ্যমে (MESA, TESA, PESA-এর মাধ্যমে) শুক্রাণু সংগ্রহ করে ইকসি করা যায়। পুরুষের বন্ধ্যত্বের ক্ষেত্রে ইকসি অত্যন্ত উন্নত ধরনের চিকিৎসা এবং এই চিকিৎসাব্যবস্থা সব সেন্টারে থাকে না। পুরুষের ক্ষেত্রে যেমন সিমেন পরীক্ষা জরুরি, তেমনি মেয়েদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হরমোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডিম্বাশয়ের জটিলতা তথা প্রতি মাসে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণ হচ্ছে কি না তা নির্ণয় করা হয়। যদি স্বামীর বীর্যের মান ঠিক থাকে এবং স্ত্রীর ডিম্বাশয়ে কোনো সমস্যা না থাকে তবে পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ফেলোপিয়ান টিউব (ডিম্বনালী) কোনো বাধা আছে কি না তা যাচাই করে দেখা। টিউবের সমস্যা আছে কি না তা দেখার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো ল্যাপারস্কপি। ল্যাপারস্কপির মাধ্যমে টিউব দেখা ছাড়াও জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না তা দেখা যায় যেমন জরায়ুর টিউমার, ডিম্বাশয়ে সিস্ট এন্ডোমেট্রিওসিস পেলভিক ইনফেকশন ইত্যাদি। টিউবে ব্লকে থাকলে টেস্ট টিউব (IVF) পদ্ধতিতে সন্তান নেয়া যায়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে হরমোন-জাতীয় ওষুধ দিয়ে ডিম্বাশয়কে নিষ্ক্রিয় করা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাম ও হরমোন পরীক্ষার মাধ্যমে যখন দেখা যায় ডিম্বাশয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে তখন আবার অন্য ধরনের হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাশয়কে সক্রিয় করা হয়। এরপর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে, স্বামীর শুক্রাণুর সাথে মিলন ঘটিয়ে ভ্রƒণ তৈরি করা হয় এবং প্রাপ্ত ভ্রƒণ জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
উপসংহার
বন্ধ্যত্ব মানেই IUI, ICSI কিংবা IVF পদ্ধতি নয়। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা নির্ভর করে বন্ধ্যত্বের কারণের ওপর। অনেক দম্পতির ক্ষেত্রে জটিল চিকিৎসাপদ্ধতির কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। ডিম্বাশয়ের অনুর্বরতা কোমিফেন সাইট্রেট কিংবা লেট্রোজল জাতীয় ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করে গর্ভসঞ্চারণ করানো সম্ভব হয়। বন্ধ্যত্ব নিয়ে আমাদের দেশে আছে হাজার কুসংস্কার। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় যেহেতু বয়সের একটা বিরাট ভূমিকা আছে তাই তাড়াতাড়ি এই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক দম্পতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, নতুন চিকিৎসকের কাছে আগের চিকিৎসকের কথা গোপন করেন এবং দেখা যায় একই ডিম নিঃসারক ওষুধ ভিন্ন নামে মাসের পর মাস খেতে থাকেন। ডিম নিঃসারক ওষুধ অনেক দিন ব্যবহারের ফলে এক দিকে যেমন ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যায় অন্য দিকে পরবর্তী জীবনে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কাজেই এই বিষয়ে প্রতিটি নিঃসন্তান দম্পতির চিকিৎসা নেয়ার সময় সচেতন থাকতে হবে। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে করতে হবে। তাই প্রতিটি দম্পতির উচিত হতাশায় না ভুগে, দু’জনে এক সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া, সব সমস্যা চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করে নেয়া।
বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা শুরুতেই গ্রহণ করলে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক ধাপ এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশও এখন আর পিছিয়ে নেই। এ দেশেও এখন IUI, IVF এবং ICSI মতো উন্নত চিকিৎসা সম্ভব। কাজেই বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা করে আপনিও হতে পারেন একটি সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক শিশুর গর্বিত পিতা-মাতা। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা শুধু স্ত্রীর চিকিৎসা নয়, স্বামী এবং স্ত্রীর দুইজনের। দুইজনকেই চিকিৎসার জন্য আসতে হবে এবং এগিয়ে যেতে হবে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে।
Comments
Post a Comment