সিলেটের মীরা বাজার। ১৯৫০-৫৫ সালের দিকের শহর। গাছপালা শোভিত, প্রাচীন
আমলের ঘর দোর, ভাঙা রাস্তা কোথাও কোথাও কাঁচা বাড়ি। আবার মাঝে মাঝে খুব
সুন্দর করে সাজানো গোছানো বনেদি বাড়ি। স্কুল ছুটির পর এমনি এক রাস্তা ধরে
হেঁটে চলছে এক বালক। দুরন্ত ঘাস ফড়িঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে তাঁর চলা।
নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই, যেন কোন একদিকে গেলেই হল। ইচ্ছে হল আর হুট করে
ঢুকে পড়ল কোন বাড়িতে। কোন কোন বাড়ি থেকে অনাহুত ভেবে বের করে দেয় আবার
কোন কোন বাড়িতে একটা ছোট্ট দেব শিশু ভেবে আদর আপ্যায়নও করে। এমনিভাবে
হাঁটতে হাঁটতে সামনে পড়ে গাছগাছালিতে ছাওয়া এক বিশাল ঘেরা জায়গা, সেখানে
ধবধবে সাদা রঙের বাংলো প্যাটার্নের একটা বাড়ি। সিলেট এম. সি. কলেজের
রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এস কে রায় চৌধুরী সাহেবের
বাড়ি। বালকের কাছে অধ্যাপকের পরিচয় হচ্ছে প্রফেসর সাব, অতি জ্ঞানী লোক -
যাঁকে দূর থেকে দেখলেই পূণ্য হয়। তো সেদিন দুপুরে সেই প্রফেসর সাবের
বাড়ির গেট খোলা পেয়ে হুট করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে বালক। গাছপালার কী
শান্ত শান্ত ভাব। মনে হচ্ছে সে যেন ভুল করে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি কোন বাড়ির
বাগানে ঢুকে পড়েছে। একা একা অনেকক্ষণ সে হাঁটল। হঠাত্ দেখতে পেল কোনার
দিকের একটি গাছের নিচে পাটি পেতে ষোল সতের বছরের একটি মেয়ে উপুর হয়ে
শুয়ে আছে। তার হাতে একটা বই। সে বই পড়ছে না- তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
বালকের মনে হল এত সুন্দর মেয়ে সে আর দেখেনি। মনে হচ্ছে মেয়েটির শরীর সাদা
মোমের তৈরি। মেয়েটি হাত ইশারায় তাঁকে ডাকল। কাছে যেতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস
করল, কী নাম তোমার খোকা? কাজল, বালকের উত্তর।
এই সেই কাজল যিনি বড় হয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে এক স্বপ্নলোকের রচনা
করেছিলেন। আর এই স্বপ্নলোকের চাবি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রফেসর
সাহেবের এই মেয়ে শুক্লা। সেই চাবিটির নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষীরের
পুতুল'।
কাজল। সিলেট থানার ওসি ফয়জুর রহমান সাহেবের বড় ছেলে। থানার দারোগা
পুলিশ সাধারণত যেমন হয়, এই একটু খিটিমিটি স্বভাব, একটু আধটু ঘুষ, জনতা
দেখে অযথাই ধমক দেওয়া তেমন নন এই ওসি সাহেব। বিপরীতে কবিতার প্রতি ঝোঁক,
গানের প্রতি দরদ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর কিছুটা বিচিত্র খেয়াল নিয়ে
এই ওসি সাহেবের জীবন। ইনি পূর্ণিমার রাতে শিশুদের আকাশ দেখাতে ভালোবাসেন।
রাত দুপুরে স্ত্রীর বায়না মেটাতে দু'জনে মিলে নেমে যান পুকুরে। মাসিক বেতন
নব্বুই টাকা যার একটা অংশ পাঠিয়ে দেন গ্রামের বাড়িতে, এক অংশ দিয়ে
প্রতি মাসে বই কেনেন, আর বাকী যা থাকে তা তুলে দেন স্ত্রীর হাতে, আর তিনি
থাকেন সারা মাস নিশ্চিন্ত। একবার এক মাসের প্রথম তারিখে খুব হাসিমুখে বাড়ি
ফিরলেন ফয়জুর রহমান। বিশ্বজয় করা এক হাসি দিয়ে স্ত্রীকে বললেন, 'আয়েশা
একটা বেহালা কিনে ফেললাম।' স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বললেন, 'কী কিনে ফেললে?'
বেহালা। বেহালা কী জন্য? বেহালা বাজানো শিখবর কত দাম পড়ল? দাম সস্তা,
সত্তর টাকা। সেকেন্ড হ্যান্ড বলে এই দামে পাওয়া গেল। ফয়জুর রহমান সংসার
চালাবার জন্য স্ত্রীর হাতে দশটি টাকা তুলে দিলেন। স্ত্রী হাসবেন না কাঁদবেন
ভেবে পেলেন না। এই বিচিত্র খেয়ালি মানুষটি শেষাবধি অবশ্য বেহালা বাজানো
শিখতে পারেননি। একদিন তাঁর সাধের বেহালা তাঁর শিশু সন্তানদের অধিকারে চলে
গেল। তারা বেহালার বাক্স দিয়ে পুতুলের ঘর বানাল। এই খেয়ালি মানুষটিই
একদিন পাহাড়ের মতো কঠিন আর অটল হয়ে গিয়েছিলেন। তখন ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের
অভ্যুদয়ের বছর। তিনি তখন পিরোজপুর থানার ওসি। পাকিস্তানি হায়েনারা তাঁর
সামনে এলে তিনি পাহাড়ের মতো অটল ও স্থির থেকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন
মৃত্যুকে। মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষায় ধনুকের ছিলার মতো বুক টান টান করে
দাঁড়িয়েছিলেন হানাদারদের বেয়নেটের সামনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার
অপরাধে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মৃতদেহ ফেলে
দেয় ধলেশ্বরী নদীর পানিতে। স্থানীয় লোকজন তাঁর মৃত শরীর পানি থেকে তুলে
নদীতীরেই দাফন করেন। পরবর্তীতে যুদ্ধশেষে তাঁর সন্তানেরা তাঁর দেহাবশেষ
সেখান থেকে তুলে আবার কবর দেন। এই শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ সাহেবের বড়
ছেলে কাজল আমাদের আজকের বাংলা কথাসাহিত্যের নতুন স্রোতের নকীব হুমায়ূন
আহমেদ। পাকিস্তান জন্মের পরের বছর জন্ম নেন হুমায়ূন আহমেদ। সাল ১৯৪৮।
তারিখ ১৩ নভেম্বর। এক শীতের রাতে। জন্ম মাতুলালয়ে, নেত্রকোণা জেলার
মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে। বাবা ফয়জুর রহমান ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম
সন্তান তিনি। ফলে অত্যধিক বাড়াবাড়ি রকমের আদরের মধ্য দিয়ে তাঁর শৈশবের
দিনগুলি রাতগুলি পার হতে থাকে। বাবার ধারণা ছিল তাঁর প্রথম সন্তান হবে
মেয়ে। তিনি মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছেন। তাঁর অনাগত কন্যা সন্তানটির জন্য
তিনি একগাদা মেয়েদের ফ্রক বানিয়ে রেখেছেন। বানিয়ে রেখেছেন রূপার মল।
তাঁর মেয়ে মল পায়ে দিয়ে ঝুম ঝুম করে হাঁটবে - তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখবেন।
কিন্তু ছেলে হওয়াতে তাঁর সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তবে তিনি হাল
ছাড়েননি। তাঁর এই পুত্র সন্তানটিকে তিনি দীর্ঘদিন মেয়েদের সাজে সাজিয়ে
রেখেছেন। এমন কি তাঁর মাথার চুলও ছিল মেয়েদের মতো লম্বা। লম্বা চুলে মা
বেণি করে দিতেন। বেণি করা চুলে রংবেরংয়ের ফিতা পরে হুমায়ূন আহমেদের
শৈশবের শুরু। তাঁর শৈশবের প্রথম অধ্যায়টি যতটা স্নেহ ও মমতায় কেটেছে
দ্বিতীয় অধ্যায়টি কেটেছে ততটাই বঞ্চনার ভেতর দিয়ে। শৈশবে তাঁর মা
টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর থেকে সুস্থ হওয়ার পর তাঁর স্মৃতিবিভ্রম
দেখা দেয়। তিনি কাউকেই চিনতে পারছেন না, এমন কি তাঁর ছেলেকেও না। ফলে
হুমায়ূন আহমেদকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে। সেখানে দু'বছর
তিনি নানা-নানির আদরে বেড়ে উঠেন। দু'বছর পর মা সুস্থ হয়ে ওঠে। এরপর দশ
বছর বয়স পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের মোহনীয় শৈশব কেটেছে। বাবার চাকুরী
সূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিচিত্র সব দৃশ্যাবলীর ভেতর দিয়ে
তিনি ঘুরে ঘুরে তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন। সিলেট থেকে বাবা বদলী হন
দিনাজপুরের জগদ্দলে। সেখানে জঙ্গলের ভেতর এক জমিদার বাড়িতে তাঁরা থাকতেন।
জগদ্দলের দিনগুলি তাঁর কাছে ছিল হিরন্ময়। বাবার সাথে জঙ্গলে ভ্রমণ করতেন।
গুলিভর্তি রাইফেল হাতে বাবা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতেন। ঘন
পাতার ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প আলো আসত। থমথমে জঙ্গল। বিচিত্র সব পাখি ডাকত।
বুনো ফুলের গন্ধ। পরিষ্কার বনে চলার পথ। বিচিত্র বন্য ফল। জঙ্গল পেরোলেই
নদী। চকচকে বালির উপর দিয়ে স্বচ্চ পানি বয়ে যেত। দুপুরে সেই নদীতে গোসল
করতেন। একবারেই আলাদা এক জীবন। জগদ্দল থেকে আবার বদলী। পঞ্চগড়ে। সেখানে
ভোরবেলা বাসার সামনে দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার শুভ্র চূড়া চোখের সামনে
ঝলমল করে উঠত। পঞ্চগড় থেকে এবার রাঙামাটি। পাহাড়ি উপত্যকায় আবার সেই
উদ্দাম ঘুরে বেড়ানোর দিন। কী লোভনীয় শৈশব কেটেছে তাঁর! হুমায়ূন আহমেদের
শৈশব কেটেছে এমনি স্বপ্নময়তার ভেতর দিয়ে। শৈশবে হুমায়ূন আহমেদ যত
জায়গায় গিয়েছেন তার মাঝে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিলো দিনাজপুরের জগদ্দল।
তার প্রধান কারণ ছিল তাঁরা যেখানে থাকতেন তার আশেপাশে কোন স্কুল ছিল না।
স্কুলের কথা মনে হলেই হুমায়ূন আহমেদের মুখ এমন তেতো হয়ে যেত যে, মনে হত
যেন তাঁর মুখে জোর করে কেউ ঢেলে দিয়েছে নিশিন্দা পাতার রস। বাবা মা তাঁকে
স্কুলে পাঠাতেন বটে তবে স্কুলে সময় কাটাতেন কেবল দুষ্টুমি করে। টেনে টুনে
পাশ করতেন। প্রাইমারি স্কুল পাশের পর এই হুমায়ূন বদলে যান। ষষ্ট শ্রেণীতে
উঠার পর থেকে স্কুলের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে। আগ্রহটা এমনি ছিল যে
এস.এস.সি. পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধা
তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে
তিনি এস.এস.সি. পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি এইচ.এস.সি. পাস
করেন। এইচ.এস.সি. পরীক্ষাতেও তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন।
ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ
থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর পাশ করে তিনি একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে
যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট
ইউনিভার্সিটি থেকে প্রফেসর যোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার
কেমিস্ট্রিতে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি নেন। ড. হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখিতে অধিক
সময় এবং চলচ্চিত্রে নিয়মিত সময় দেবার জন্য পরবর্তীতে অধ্যাপনা পেশা
ছেড়ে দেন। বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ। গত
কয়েক দশক ধরেই তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। ১৯৭২ সালে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে
তাঁর আত্মপ্রকাশ। 'নন্দিত নরকে' যখন প্রকাশ হয় তখনই বোঝা গিয়েছিলো কথা
সাহিত্যের কঠিন ভুবনে তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি, থাকতেই এসেছেন। ফলে এদেশের
সাহিত্যাকাশে তিনি ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন। তাঁর মধ্যে এই অমিত
সম্ভাবনা তখনই টের পেয়ে প্রখ্যাত লেখক সমালোচক আহমদ শরীফ এক গদ্যের
মাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দিত করেছিলেন। আহমদ শরীফের প্রশংসা যে অপাত্রে ছিল না
তা তো আজ সর্বজন বিদিত। মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা সহজ সরল গদ্যে তুলে ধরে
পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। শুধু মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা বয়ানেই
সীমিত নয় তাঁর কৃতিত্ব, বেশ কিছু সার্থক সায়েন্স ফিকশন-এর লেখকও তিনি।
জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমুর স্রষ্টা তিনি- যে দু'টি চরিত্র যথাক্রমে
লজিক এবং এন্টি লজিক নিয়ে কাজ করে। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের ভিতটা
গড়ে ওঠে পারিবারিক বলয় থেকেই। বাবা ছিলেন সাহিত্যের অনুরাগী। বাসায়
নিয়মিত সাহিত্য আসর বসাতেন, সেই আসরের নাম ছিলো সাহিত্য বাসর। গল্প লেখার
অভ্যেসও ছিল তাঁর। যদিও সেসব গল্প কোথাও ছাপা হয়নি। তবে গ্রন্থাকারে তা
প্রকাশিত হয়েছিলো। গ্রন্থের নাম 'রিক্তশ্রী পৃথিবী'। তাঁর বাবা সন্তানদের
মধ্যে যেন সাহিত্য বোধ জেগে ওঠে সে চেষ্টা করেছেন সবসময়। মাঝে মাঝে দেখা
যেত তিনি নির্দিষ্ট একটা বিষয় দিয়ে ছেলেমেয়েদের কবিতা লিখতে বলতেন,
ঘোষণা করতেন যার কবিতা সবচেয়ে ভাল হবে তাকে দেওয়া হবে পুরস্কার। হুমায়ূন
আহমেদের বড় মামা শেখ ফজলুল করিম যিনি তাঁদের সাথেই থাকতেন এবং যিনি ছিলেন
তাঁদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী, তিনি কবিতা লিখতেন, লিখতেন নাটক এবং সেই নাটক
তিনি তাঁর ভাগ্নে-ভাগ্নিদের দিয়ে বাসায় গোপনে গোপনে মঞ্চস্থও করাতেন। আর
হুমায়ূন আহমেদের নিজের ছিল গল্প উপন্যাসের প্রতি অসাধারণ টান। তাঁর এই টান
তৈরি করে দিয়েছিলেন মীরা বাজারের প্রফেসর রায় চৌধুরী সাহেবের মেয়ে
শুক্লা। যিনি তাঁকে 'ক্ষীরের পুতুল' নামের বইটি উপহার দিয়ে সাহিত্যের
প্রতি এই অসাধারণ টানের সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথম যেদিন তিনি ওই বাড়িতে (যে
বাড়ির বর্ণনা লেখার শুরুতে দিয়েছি) যান শুক্লা তখন তাঁকে মিষ্টি খেতে
দিয়েছিলেন। মিষ্টির লোভে দ্বিতীয় দিন আবার সেই বাড়িতে গেলে শুক্লা আবার
তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। তৃতীয় দিন তিনি তাঁর ছোট বোন শেফালিকে নিয়ে যান।
শুক্লাদের বাড়িতে তখন মিষ্টি ছিল না। শুক্লা তখন মিষ্টির পরিবর্তে তাঁদের
হাতে তুলে দেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষীরের পুতুল' বইটি। 'ক্ষীরের
পুতুল' হলো হুমায়ূন আহমেদের পড়া প্রথম সাহিত্য। যদিও তার বাবার বিশাল
লাইব্রেরি ছিলো। কিন্তু সমস্ত বই তিনি তালাবদ্ধ করে রাখতেন। তিনি হয়ত
ভেবেছিলেন তাঁর বাচ্চাদের এসব বই পড়ার সময় এখনো হয়নি। কিন্তু 'ক্ষীরের
পুতুল' পড়ার পর তিনি তাঁর বাবার বইয়ের আলমারী থেকে বই চুরি করে লুকিয়ে
পড়তে শুরু করলেন এবং একদিন বাবার হাতে ধরা পড়ে গেলেন। বাবা তাঁকে নিয়ে
গেলেন সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ
সেখানে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বই আর বই। বাবা তাঁকে লাইব্রেরির সদস্য করে
দিলেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন এই লাইব্রেরির সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। এইভাবে
হুমায়ূন আহমদের সাহিত্যের প্রতি জন্ম নেয় গভীর ভালোবাসা।
যদিও তাঁর প্রথম রচনা 'নন্দিত নরকে', তবে তারও বহু পূর্বে তিনি একটি
সাহিত্য রচনা করেছিলেন। দিনাজপুরের জগদ্দলে থাকা অবস্থায়। জগদ্দলের যে
জমিদার বাড়িতে তাঁরা থাকতেন। সেখানে জমিদারের পরিত্যক্ত সম্পত্তির
তালিকায় ছিল একটি কুকুর। জমিদারের অনেকগুলি কুকুর ছিল। তিনি সবকটি কুকুরকে
নিয়ে যেতে চাইলেও এই কুকুরটি যায়নি। রয়ে গিয়েছিল বাড়ির মায়ায় আটকা
পড়ে। কুকুরটির নাম ছিলো বেঙ্গল টাইগার। তাঁরা যেখানেই যেতেন কুকুরটি সাথে
সাথে যেত। কুকুরটির সাথে তাঁদের একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। একদিন
ভোরবেলা হুমায়ূন আহমেদ জমিদার বাড়ির মন্দিরের চাতালে বসে আছেন তাঁর সাথে
আছে ছোট বোন শেফালি ও ছোট ভাই জাফর ইকবাল। কিছুক্ষণ পর তাঁর মা তাঁদের সবার
ছোট ভাই আহসান হাবীবকে বসিয়ে রেখে গেলেন, আর তাঁদের উপর দায়িত্ব দিয়ে
গেলেন তাঁকে দেখে রাখার জন্য। মা চলে যাওয়ার পর দেখতে পেলেন একটা প্রকাণ্ড
কেউটে দরজার ফাঁক থেকে বের হয়ে এসেছে। ফণা তুলে হিস হিস শব্দে সে আহসান
হাবীবের দিকে এগিয়ে আসছে। ঠিক তখুনি বেঙ্গল টাইগার ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপটির
ফলা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে। সাপও তার মরণ ছোবল বসিয়ে দিয়ে যায় কুকুরের
গায়ে। দু'দিন পর যখন বিষক্রিয়ায় কুকুরের শরীর পচে গলে যেতে থাকে তখন
তাঁদের বাবা মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য কুকুরটিকে গুলি করে
মেরে ফেলেন। এই ঘটনা হুমায়ূন আহমেদের মনে গভীর দাগ কাটে। এই কুকুরকে
নিয়েই তিনি প্রথম কিছু লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন 'বেঙ্গল টাইগার' (অথবা
'আমাদের বেঙ্গল টাইগার')। তারপর ১৯৭২ সালে 'নন্দিত নরকে' রচনা করেন। তারপর
তো সবই ইতিহাস। একে একে 'শঙ্খনীল কারাগার', 'রজনী', 'গৌরিপুর জংশন',
'অয়োময়ো', 'দূরে কোথাও', 'ফেরা', 'কোথাও কেউ নেই', 'আমার আছে জল',
'অচিনপুর', 'এইসব দিনরাত্রি'সহ দুই শতাধিক উপন্যাসের জনক হূমায়ূন আহমেদ।
পেশাগত জীবনে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন
শাস্ত্রের অধ্যাপক। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের মাঝে তিনি ছিলেন তুমুল
জনপ্রিয়। আর ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি এতটাই জনপ্রিয় যে শরত্চন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের পর বাংলা কথাসাহিত্যে এত জনপ্রিয়তা আর কারও মাঝে দেখা
যায়নি। তিনি যেন গল্পের সেই পরশ পাথর- যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই ফলেছে
সোনা। কেবল অধ্যাপনা আর কথাসাহিত্যই নয়, তিনি যখন অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে
চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিলেন সেখানেও সাফল্যদেবী তাঁর মুঠোয় ধরা দিয়েছে।
তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমনি'। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই
চলচ্চিত্রটি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছিল। মাসের পর মাস ধরে এই
চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস দখল করে রেখেছিল। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি
শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এই ছবিটি। তাঁর
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র 'শ্যামল ছায়া' বিদেশী ভাষার ছবি
ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অন্য কীর্তি
'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী', 'চন্দ্রকথা' প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলি
কেবল সুধীজনের প্রশংসাই পায়নি, মধ্যবিত্ত দর্শকদেরও হলমুখী করেছে বহুদিন
পর। টিভি নাট্যকার হিসেবেও তিনি সমান জনপ্রিয়। তাঁর প্রথম টিভি নাটক 'এইসব
দিনরাত্রি' মধ্য আশির দশকে তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর
হাসির নাটক 'বহুব্রীহি' এবং ঐতিহাসিক নাটক 'অয়োময়ো' বাংলা টিভি নাটকের
ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক 'কোথাও কেউ নেই'-এর চরিত্র
বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। নাটকের শেষে বাকের
ভাইয়ের ফাঁসির রায় হলে ঢাকার রাজপথে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবীতে মিছিল
হয়েছিলো। বাংলা নাটকের ইতিহাসে এমনটি আর হয়নি কখনো। এছাড়াও অসংখ্য
বিটিভি ও প্যাকেজ নাটকের নির্মাতা তিনি। নাট্যকার- নির্দেশক দুই ভূমিকায়ই
সমান সফল। সফল শিল্পের আরেকটি শাখা চিত্রকলাতেও। তাঁর চিত্রশিল্পের
স্বাক্ষর নিজ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের জন্ম
পীরবংশে। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার বিখ্যাত পীর জাঙ্গির মুনশি'র
ছেলে মৌলানা আজিমুদ্দিন হুমায়ূন আহমেদের দাদা। তিনি ছিলেন একজন উঁচুদরের
আলেম এবং মৌলানা। হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ
অফিসার আর মা ছিলেন গৃহিনী। তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি সবার বড়। তাঁর
ছোটভাই জাফর ইকবাল একজন প্রখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী। শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনিও একজন কথাসাহিত্যিক। সবার ছোট
ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট এবং রম্য লেখক। দেশের একমাত্র কার্টুন
পত্রিকা উন্মাদ'র কার্যনির্বাহী সম্পাদক। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে
গুলতেকিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার
ছেলে-মেয়ে। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে
ডিভোর্সের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী ও
পরিচালক মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। শাওন ১৯৯০ সাল থেকে টিভিতে অভিনয়
শুরু করেন। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হন। শৈশবের বালক
হুমায়ূন আহমেদ যেমন ভালোবাসতেন গাছপালা শোভিত সবুজ অরণ্যানীর ভেতর ঘুরে
বেড়াতে, বিটোফেনের সুরের মতন টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে, তেমনি এই ষাট
বছরেও তাঁর সবুজের ভেতর হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে আজও বৃষ্টির
শব্দের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। ইট কাঠের খাঁচায় বন্দী এই রাজধানী ঢাকা
তাঁর দম বন্ধ করে আনে। আর তাই তিনি গাজীপুরের শালবনের ভেতর তৈরি করেছেন এক
বিশাল নন্দন কানন নুহাশ পল্লী। তাঁর বেশির ভাগ সময়ই কাটে নুহাশ পল্লীর
শাল গজারির সাথে কথা বলে, বৃষ্টির শব্দের সাথে মিতালি করে। সংক্ষিপ্ত
পরিচিতি
জন্ম : ১৯৪৮, ১৩ নভেম্বর। নেত্রকোণা জেলার কুতুবপুর গ্রামে। বাবা : ফয়জুর
রহমান আহমেদ। মা : আয়েশা ফয়েজ। স্ত্রী : মেহের আফরোজ শাওন। শিক্ষা :
মাধ্যমিক, বগুড়া জিলা স্কুল, ১৯৬৫। উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ, ১৯৬৭।
স্নাতক (সম্মান) রসায়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭০। স্নাতকোত্তর (রসায়ন)
১৯৭২। পিএইচ.ডি., নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি, ১৯৮২। পেশা : অধ্যাপনা, রসায়ন
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর, বর্তমানে লেখালেখি ও
চলচ্চিত্র নির্মাণ। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি,
শঙ্খনীল কারাগার, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথায়, সৌরভ, নী, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ,
সাজঘর, বাসর, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি,
দারুচীনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি,
শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, জোছনা ও জননীর
গল্প প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া,
শ্রাবন মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত। পুরস্কার
: একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির
স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত
পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস
পুরস্কার (১৯৮৮)। দেশের বাইরেও হয়েছেন মূল্যায়িত। জাপান
টেলিভিশন NHK তাঁকে নিয়ে একটি পনের মিনিটের ডকুমেন্টারি প্রচার করেছেWho
is who in Asia শিরোনামে৷
DOWNLOAD ALL BOOKS